মো. ইউসুফ আলী,বাকৃবিঃ
ভেড়ার ভ্রুণ উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং হিমায়িত ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করে বাচ্চা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের এক দল গবেষকরা। জন্ম নেয়া ভেড়ার বাচ্চা দুটির নাম দেয়া হয়েছে“বাউভি আশা” ও “বাউভি উৎস”। গবেষকদের দাবি, জন্ম নেয়া বাচ্চা দুটি বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রথম হিমায়িত ভ্রুণ বা”্চা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যানিমেল ফার্মে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সাফল্যের কথা জানান প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. নাছরিন সুলতানা জুয়েনা। এ কাজে অন্যান্য সহযোগী গবেষকরা হলেন, অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমীন বারী ও পিএইচডি ফেলো রফিকুল ইসলাম তালুকদার।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. নাছরিন সুলতানা জুয়েনা বলেন, বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার প্রচলন থাকলেও গবাদিপশুর গর্ভধারণের হার এখন পর্যন্ত আশানুরূপ নয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ভেড়া ও গরুর কম সময়ে অধিক বাচ্চা উৎপাদনের জন্য হেকেপ প্রকল্পে ২০১৪ সাল থেকে কাজ শুরু করি। যার লক্ষ্য ছিল ১. মানসম্পন্ন স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গবেষণার সক্ষমতা জোরদার করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ২. রোমন্থক প্রাণীর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণালব্ধ লাগসই প্রজনন সহায়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা ৩. খামার পর্যায়ে লাগসই প্রযুক্তিগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে রোমন্থক প্রাণির উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশে দীর্ঘকাল হতে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা প্রচলন থাকলেও বহুমাত্রিক কারণে গর্ভধারণের হার এখন পর্যন্ত আশানুরূপ নয়। এই উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নতজাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং তা মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গর্ভধারণের হার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই সংগে লিঙ্গ নির্ধারণী (Pre-sexed) শুক্রাণু প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তা মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে গাভীর ভ্রুণ উৎপাদন ও প্রতিস্থাপন প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে অনুপস্থিত ছিল। এই উপ-প্রকল্প উক্ত প্রযুক্তিদ্বয় অর্জনে ও দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উন্নত জাতের গাভী ও দেশীয় ভেড়ী হতে ভ্রুণ উৎপাদন, ভ্রুণগুলোকে মাঠ পর্যায়ে গাভী ও ভেড়ীতে প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে সংরক্ষণ (Vitrification) এবং উন্নতজাতের ষাঁড় হতে উচ্চমানসম্পন্ন লিঙ্গ নির্ধারণী শুক্রাণু উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে চলমান প্রকল্পটি অগ্রসর হচ্ছে। একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজনন কৌশল তৈরীর জন্য বিজ্ঞানী, ব্রিডার ও সমাজ তথা খামারীদের যৌথ প্রয়াস আবশ্যক। সাশ্রয়ী ও টেকসই প্রাণী প্রজনন সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষকের চাহিদা পূরণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে গুরত্বপূর্ন অবদান রাখা জরুরী।
প্রকল্পের আওতায় চলমান গবেষণা কার্যসমূহ:
১. প্রচলিত কৃত্রিম প্রজননের প্রাপ্ত বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণী নিয়ামক সমূহ নির্ণয়
২. উন্নতজাতের ষাঁড় হতে প্রাপ্ত উচ্চমানসম্পন্ন সিমেন ও লিঙ্গনির্ধারনী শুক্রাণুর প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও মাঠ পর্যায়ে বিতরণ
৩. উন্নতজাতের গাভীর ভ্রুণ উৎপাদন, লিঙ্গনির্ধারণ, সংরক্ষণ ও মাঠ পর্যায়ে সাধারণ জাতের গাভীতে প্রতিস্থাপন
৪. উন্নতজাতের ভেড়ীর ভ্রুণ উৎপাদন, লিঙ্গনির্ধারণ, সংরক্ষণ ও মাঠ পর্যায়ে দেশীয় ভেড়ীতে প্রতিস্থাপন
ইতোমধ্যে ১১টি ভেড়ীতে ২২টি হিমায়িত ভ্রুণ এবং ৪টি গাভীতে ৮টি হিমায়িত ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হিমায়িতভ্রুণ প্রতিস্থাপিত ১১টি ভেড়ীর মধ্যে গত ২ মে মঙ্গলবার রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে একটি ভেড়ী ২টি শাবক প্রসব করেছে বাচ্চা দুটির নাম দেয়া হয়েছে বাউ-ভি আশা ও বাউ-ভি উৎস। ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ভেড়ার বাচ্চা উৎপাদনের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম।
গবেষণা সহযোগী রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, সাধারণ নিয়মে প্রতিটি ভেড়ী বছরে সর্বোচ্চ ৪টি এবং গাভী বছরে ১টির মতো বাচ্চা প্রসব করতে পারে। কিন্তু আমাদের ব্যবহৃত বিশেষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত উন্নত জাতের ভেড়ী ও গাভী থেকে সুপার ওভুলেশনের মাধ্যমে বছরে ২৫ থেকে ৩০টি উচ্চ গুণসম্পন্ন ভ্রুণ উৎপাদন করা সম্ভব। ওই ভ্রুণ তরল নাইট্রোজেনে মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যাবে। সংরক্ষিত ভ্রুণ প্রয়োজন মত আমরা অন্য ভেড়ীতে দিয়ে তা থেকে সহজে উন্নত জাতের বাচ্চা পেতে পারি। এতে করে একজন খামারী অতি অল্পসময়ে গবাদিপ্রাণির জাত উন্নয়ন করতে পারবেন।
প্রকল্প সহকারী গবেষক অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিন বারী বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো এখানে গবাদিপ্রাণির ভ্রুণ সংরক্ষণ ও প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে কৃষকরা প্রয়োজনমতো ভ্রুণ সংগ্রহ করে তা যে কোন সময় প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। এতে গবাদি প্রাণির মানসম্মত প্রজনন নিশ্চিত করা সহজ হবে। ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগে স্থায়ী সিমেন ও ভ্রুণব্যাংক তৈরী করা হবে বলেও জানান গবেষকরা। উদ্ভাবিত হিমায়িত ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি গবাদি প্রাণির খামারে প্রয়োগের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন গবেষকরা।