কৃষিবিদ নিয়াজ মুর্শীদ
মরিচের রোগ ব্যাধি ঃ মরিচের উৎপত্তি মূলত ল্যাটিন আমেরিকার দক্ষিণের ট্রপিক্যাল অঞ্চল থেকে। সোলানেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মরিচের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাপ্সিকাম আনাম/কাপ্সিকাম ফ্রুটিসেন্স যা সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৭৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে থাকে। মরিচের বহুব্যাধি ব্যাবহারের (যেমন ওষুধ শিল্প, কসমেটিক শিল্প, রন্ধন শিল্প ইত্যাদি) জন্য ইহা অর্থনীতিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। পাশাপাশি পুষ্টিগুণ, ঔষধি গুরুত্ব ও মশলা শিল্পের বহুল ব্যাবহারের জন্য মরিচের উৎপাদনের সাথে অর্থনীতিক সচ্ছলতা ওতপ্রেত ভাবে জরিত।
বাংলাদেশে মরিচ একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ মশলা ফসল যা প্রায় ৬৬২৩৫ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৫২২১৫ মেট্রিক টন উতপাদিত হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া মরিচ উৎপাদনের উপযুক্ত বলে এর উৎপাদন দিন দিন বেরেই চলছে। দেশের সর্বত্র এর উৎপাদন হলেও বেশিরভাগ মরিচ উৎপাদন হয় বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নাটোর ও যশোর অঞ্চলে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সবজি রান্না ও সালাদ তৈরিতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে কাচাঁ মরিচ। অপরদিকে মরিচের উৎপাদনের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রোগ-বালা্ ও পোকা-মাকড় অন্যতম। মরিচের উৎপাদন মেীসূমে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টিপাত, পর্যায়ক্রমে উচ্চ তাপমাত্রা ও আদ্র আবহাওয়া রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড় আক্রমনের অন্যতম কারন। ফলে মরিচের উৎপাদনে উচ্চমাত্রায় ব্যবহৃত হয় ক্ষতিকর কীটনাশক। রোগ-বালাই, পোকা-মাকড় এবং এর দমন পদ্ধতি সর্ম্পকে সঠিক ধারন না থাকায় না বুঝে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারে এদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে অন্যদিকে বাড়ছে মারাত্মক সাস্থ্য ঝুঁকি। মরিচ উৎপাদনে একমাত্র জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার ই পারে উৎপাদন খরচ ও সাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে। আসুন পরিচিত হই মরিচের রোগ-বালাই, পোকা-মাকড় এবং এর জৈব বালাইনাশকের সাথে।
মরিচের রোগঃ
১. ঢলে পড়াঃ গাছের গোড়ায় ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়। ভিজা এবং স্যাতস্যাতে জমিতে বিশেষ করে যেসমস্ত জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই সেসকল জমিতে এই রোগ বেশি হয়।
লক্ষনঃ
⦁ এ রোগের আক্রমন দেখা দিলে গাছের পাতা ও কান্ড নেতিয়ে পরে।
⦁ শিকর নরম ও ভেজা মনে হয়।
⦁ কান্ড বাদামী বর্ণ ধারন করে।
বিস্তারঃ সাধারণত বীজ, মাটি ও পানির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ উঁচু জমিতে মারিচে চাষ করতে হবে।
⦁ জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের সাথে ৫০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” পেস্ট করে মিশিয়ে বীজ বপণ করতে হবে।
⦁ বীজ বা চারা লাগানোর পূর্বে শেষ চাষের সময় প্রতি ৩ শতাংশ জমিতে ১ কেজি হারে “বায়োডার্মা সলিড” প্রয়োগ করে মাটি শোধন করতে হবে।
⦁ জমিতে আক্রমন দেখা দিলে প্রথমে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং প্রতি ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
২. শিকর পচাঁ ও গোড়া পচাঁঃ গাছের শিকর ও গোড়ায় ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়। ভিজা এবং স্যাতস্যাতে জমিতে বিশেষ করে যেসমস্ত জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই সেসকল জমিতে এই রোগ বেশি হয়। চারা অবস্থায় নার্সারীতে এ রোগের আক্রমন বেশী দেখা যায়।
লক্ষনঃ
⦁ চারা এবং গাছের শিকর পচেঁ যায়।
⦁ চারার গোড়ায় পানিভেজা দাঁগ পরে ও পচেঁ গিয়ে চারা ঢলে পরে।
বিস্তারঃ সাধারণত বীজ, মাটি ও পানির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ উঁচু জমিতে মারিচে চাষ করতে হবে।
⦁ জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের সাথে ৫০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” পেস্ট করে মিশিয়ে বীজ বপণ করতে হবে।
⦁ বীজ বা চারা লাগানোর পূর্বে শেষ চাষের সময় প্রতি ৩ শতাংশ জমিতে ১ কেজি হারে “বায়োডার্মা সলিড” প্রয়োগ করে মাটি শোধন করতে হবে।
⦁ প্রতি ১ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে উক্ত পানিতে মরিচের চারা ১০ মিনিট ভিজিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
⦁ জমিতে আক্রমন দেখা দিলে প্রথমে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং প্রতি ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
৩. কান্ড পচাঁ ও পাতা পচাঁঃ গাছের কান্ড পচাঁ ও পাতায় ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়। আদ্র আবহাওয়ায় এই রোগ বেশি হয়।
লক্ষনঃ
⦁ প্রথমে কান্ড ও পাতায় পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
⦁ পরবর্তীতে দাগ বৃদ্ধি পায় ও আক্রান্ত অংশ কালচে রং ধারন করে।
⦁ কান্ড ও পাতা দ্রুত পঁচে যায়।
⦁ এ রোগে ফুল এবং ফল ও আক্রান্ত হতে পারে।
বিস্তারঃ সাধারণত বীজ, বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের সাথে ৫০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” পেস্ট করে মিশিয়ে বীজ বপণ করতে হবে।
⦁ আক্রান্ত কান্ড, পাতা, ফুল বা ফল অথবা গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
⦁ প্রতি ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৪. পাতায় দাগঃ গাছের পাতায় ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়। আদ্র আবহাওয়ায় এই রোগ বেশি হয়।
লক্ষনঃ
⦁ প্রথমে পাতায় গোলাকার বাদামি দাগ দেখা যায়।
⦁ পরবর্তীতে দাগটি বৃদ্ধি পায় এবং চারিদিকে খয়েরি বর্ণ ধারণ করে।
⦁ আক্রান্ত অংশের পাতা শুকিয়ে যায় ও দাগের মাঝখানে ছিদ্র দেখা যায়।
⦁ আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়।
বিস্তারঃ সাধারণত বীজ, বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ উঁচু জমিতে মারিচে চাষ করতে হবে।
⦁ জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
⦁ প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের সাথে ৫০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” পেস্ট করে মিশিয়ে বীজ বপণ করতে হবে।
⦁ প্রতি ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৫. পাতা কুঁকড়ানোঃ পাতা কুঁকড়ানো একপ্রকার ভাইরাস। যে কোন বয়সের গাছ আক্রান্ত হতে পারে তবে বয়স্ক গাছই বেশী আক্রান্ত হয়। এ রোগের আক্রমনে বৃদ্ধি ব্যহত হয় ও ফলন কমে যায়। ভাইরাস আক্রান্ত গাছ মরে যায় না তবে পুনরায় স্বাভাবিক ও হয় না। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বেশী হলে এ রোগের প্রকপ দেখা দেয়।
লক্ষনঃ
⦁ আক্রান্ত গাছের পাতা কুঁকড়িয়ে যায়।
⦁ আক্রান্ত গাছের পাতা সাধারণ পাতা অপেক্ষা পুরু হয়।
⦁ পাতা হলুদ বর্ণ ধারন করে।
বিস্তারঃ আক্রান্ত গাছ, বিভিন্ন প্রকার শোষক পোকা পানির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ আশে পাশের অন্যান্য পোষক উদ্ভিদ ধ্বংশ করতে হবে।
⦁ সুস্থ ও সবল চারা লাগাতে হবে।
⦁ রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
⦁ প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে “ইকোম্যাক” ও ১ মিলি হারে “কেমাইট” ১ সপ্তাহ অন্তর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে।
৬. ফল পচাঁঃ ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়। আদ্র আবহাওয়ায় এই রোগ বেশি হয়।
লক্ষনঃ
⦁ পরিপক্ক ফলের উপরিভাগে পানিভেজা উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতির দাগ দেখা যায়।
⦁ দাগগুলোর উপরে হলদে থেকে ধূসর ও অভ্যন্তরে বাদামি থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে।
⦁ আক্রান্ত ফলের বীজ কালো হয়ে যায়।
বিস্তারঃ সাধারণত বীজ, বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
⦁ সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
⦁ প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের সাথে ৫০ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” পেস্ট করে মিশিয়ে বীজ বপণ করতে হবে।
⦁ আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
⦁ প্রতি ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম “বায়োডার্মা পাউডার” ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।