মোঃ বশিরুল ইসলাম
বিজয়ের ৪৬ বছরে কৃষির সাফল্য
বছর ঘুরে আবার এসেছে বিজয় মাস। আমার জন্ম সেই সময়ের অনেক অনেক পরে বিধায় আমি স্বচক্ষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরে বিজয় দেখিনি। তবে কৃষি বিজয় দেখছি। কৃষিতে পড়ালেখা করে এ নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত দেখে সহজে অনুমান করা যায় কৃষিতে যে বিজয় হয়েছে। এ বিশাল বিজয়ে পিছনে কৃষিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষকের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ সাথে সরকারের সময়োপযোগী কৃষিনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে কৃতিত্বও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। শুধু মাঠে নয়, নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে কৃষির আরেকটি উপ-খাত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের নিরলস পরিশ্রমের যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সাফল্য আসছে ধারাবাহিক গতিতে।
১৯৭১ সালে এই দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। ভূমির অনুপাতে লোকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিবছর লোখ সংখ্যা বাড়ছেই। সে তুলনা কৃষি জমি এক শতাংশও বাড়ছে না। আর বাড়ানোরও কোনো সুযোগ দেখছি না। যেসব কৃষি জমি দখল হয়ে গেছে তা ফেরানো সম্ভব নয়। কেউ স্থাপনা, কারখানা ভেঙে কৃষি জমি উদ্ধার করবে না। বরং উল্টোটা করতে সবাই আগ্রহী। এছাড়া রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। এসবে মধ্যেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম, ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে আমাদের এ সোনার বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দেড় টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ছয় টন। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
একসময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। ব্লাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আম উৎপাদনের বিশ্বে মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উপস্থাপনে। আর আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে আমাদের এ দেশ। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রফতানি হচ্ছে বিদেশে।
বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।
এবার বাজারে ইলিশ মাছের সরবরাহ এত বেশি ছিল যে, এর দাম ছিল সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে। ধনী, দরিদদ্র সবাই এর স্বাদ নিতে পেরেছে। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদনে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।
খাদ্য উৎপাদনে এমন একটি সফল প্রেক্ষিত রচনা করতে কৃষককে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে- সেই কথাটি বিজয়ের ৪৬ বছরে এসে আমরা কি ভাবছি? দেশের মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিতে গিয়ে কৃষক কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে সে বিষয়টিই আজ খতিয়ে দেখার দিন। আজ আমাদের কৃষি সাফল্য পাশাপাশি একটি নেতিবাচক দিকও সূচিত হয়েছে। তা হচ্ছে, আমাদের কৃষকরা বছরের পর বছর তাদের বহু কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আমরা কোনো পদ্ধতিতেই নিশ্চিত করতে পারছি না কৃষি পণ্যের সঠিক মূল্য।
আমাদের কৃষিক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এলেও বর্তমানে একটি সমস্যা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। তা হলো চাষাবাদযোগ্য জমির সঙ্কোচন। এখন প্রতি বছর শতকরা প্রায় একভাগ চাষাবাদের জমি হ্রাস পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে চাষাবাদ তথা খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ চাষযোগ্য জমি কমে গেলে প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাবে। তখন হয়তো উন্নতমানের যাবতীয় প্রযুক্তি এবং উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। যদি তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। এজন্য এখন থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে, আবাদি জমি যাতে কোনোভাবে শিল্প কারখানা স্থাপন, বাসস্থান, তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতে না পারে, সে জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করা দরকার।
বাংলাদেশের কৃষিতে নুতন প্রযুক্তি এসেছে, বেড়েছে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রূপান্তর ঘটছে সনাতন কৃষিতে, যা কৃষির জন্য এক বিরাট সাফল্য এবং যে সাফল্যকে বাস্তবরূপ দিতে পেরেছে বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা, নির্দেশনা আর আন্তরিক প্রয়াস। একসময়, শিল্পে আহংকার করার মত বড় খাত ছিল পাট শিল্প। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে এই খাত নানা কারনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পাটশিল্পকে আবার হারানো গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে পারলে তা হবে এক বড় অনুপ্রেরণার জায়গা।
বিজয় মাসে কৃষকের পক্ষ থেকে সরকার, নীতি-নির্ধারক সবার কাছে আহবান- আসুন স্বাধীনতার পর এদেশে সবচেয়ে বড় অর্জন যাদের, সেই কৃষকের পাশে দাঁড়াই। তাদের পন্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করি।
লেখকঃ
জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়