মাটির উর্বরতা হ্রাস ফলে প্রকৃতির সর্বনাশ হচ্ছে প্রতিনিয়ত

মাটির উর্বরতা হ্রাস

কৃষিবিদ মো:নূরুল হুদা আল মামুন:
Soil Erosion

কৃষি মানব সভ্যতার ভিত। বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষি অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু ভূমির উর্বরতা হ্রাসের মাধ্যমে কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ। মাটির উর্বরতা হ্রাস বা অবক্ষয় হলো এক ধরনের প্রকৃতিগত অবক্ষয় যার কারণে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় পরিশেষে মাটির স্বাস্থ্যহানী ঘটে। আর স্বাস্থ্যহীন মাটির কারনে ফসল যেমন কমে যায় তেমনি প্রকৃতি বা পরিবেশে ও সর্বনাশ ডেকে আনে। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হচ্ছে প্রতি বছর নতুন নতুন কৃষি জমি মৃত্তিকা ক্ষয় বা উর্বরতা হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানী ঝধীবহধ ২০০৪ সনে উল্লেখ করেন, “প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ হেক্টরের অধিক উর্বর কৃষি জমি মরুকরণের ফলে অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে যার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৪৫০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মারাত্মক বির্পযয়ের কারণও বটে। বিভিন্ন কারনে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় সেগুলো হলো-
জমিতে লবনাক্ত পানি প্রবেশ করলে বা সেচ দিলে: বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রতিবছর সমূদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করে আবাদি জমি অনুর্বর করে ফেলে। এতে ফসলের উৎপাদন কমে যায় মারাত্মকভাবে। অন্যদিকে ঐ অঞ্চলের প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র সংকটাপন্ন হওয়ার যোগাড়। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, লবণের কারণে ফসলের উৎপাদন ৭০ শতাংশ কমে যায়। অনেক সময় কোন উৎপাদনই হয় না। লবণের প্রভাবে মাটির উর্বরতা এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়, ফুল আসে না, পরাগায়নের উন্নয়ন হয় না। রোপা আমনে তেমন ক্ষতি না হলেও রবিশস্য লবণ সহ্য করতে পারে না। লবণ বিস্তারের কারণে তিন ফসলী জমি এক ফসলী হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে শস্য বিন্যাস। লবনাক্ত মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জিঙ্কের পরিমাণ কমে যায়। মাটির লবণাক্ততার ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম হার কমে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ফলে ফলন কমে যায়। তাছাড়া সেচের পানিতে দ্রবীভূত লবণ থাকে। এই লবণ মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে। ফলে মৃত্তিকার স্বাভাবিক গুণাবলী ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। বর্তমানে বিশ্বে সেচভুক্ত কৃষিভূমির ২১ শতাংশ তীব্র লবণাক্ততা ও ৩০ শতাংশ মাঝারি লবণাক্ততা ঝুঁকির মধ্যে আছে।
নদী ভাঙ্গন: নদী ভাঙ্গনের কারনে প্রতিবছর আবাদি জমির বিরাট একটা অংশ নদী বক্ষে বিলীন হয়ে যায়। মার্কিন ভূতত্ত্ববিদ শ্যালডন জুডসন এর ভূমিক্ষয় জনিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রতি বছর প্রায় ২৪ হাজার মিলিয়ন মেট্রিক টন উর্বর মাটি নদীতে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রের তলদেশে জমা হয়। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্বের সমগ্র কৃষিজমিতে যে পরিমাণ মাটি জমছে তার চেয়ে ২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
অনুমান ভিত্তিক রাসয়নিক সার প্রয়োগ: অধিক ফসল ফলানোর জন্য রাসয়নিক সার ব্যবহার আবশ্যক। কিন্তু রাসয়নিক সারের একটা বিষক্রিয়া আছে। মাটিতে বেশি মাত্রায় ব্যবহার করলে তা যেমন ফসলের জন্য অনিষ্টের কারণ তেমনি মাটির প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মাটিতে রয়েছে অনেক উপকারি অনুজীব,কীটপতঙ্গ এবং ‘প্রকৃতির লাঙ্গল’ নামে পরিচিত কেঁেচা। অতিমাত্রায় রাসয়নিক সার এসব অনুজীবের বংশ বৃদ্ধি ও বেচেঁ থাকার জন্য সহায়ক নয়। অনেক কৃষক সুষমমাত্রায় সার ব্যবহার না করে অধিকহারে অনুমান ভিত্তিক সার ব্যবহার করেন ফলে মাটির ইকোসিস্টেম ধ্বংশ হয়।
জৈব সার ব্যবহার না করা: জৈব পদার্থ কে মাটির প্রাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যে মাটির জৈব পদার্থ যত বেশি সে মাটি তত সমৃদ্ধ। একটি আদর্শ মাটিতে ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে একভাগেরও কম জৈব পদার্থ আছে। যা কাংঙ্খিত নয়। আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষি জমিতে জৈব সার প্রয়োগ না করে বা ফসলের পর্যায়ক্রম না মেনে বছরের পর বছর ফসল জন্মানোর ফলে মাটির উপরিভাগের ক্ষয় আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। এর ফলে মাটি অনুর্বর বা স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে। এরুপ মাটির কারনে মাটিতে উপকারি অনুজীবের পরিমান কমে যায়। অর্থাৎ মাটির প্রকৃতি বা পরিবেশ বিনষ্ট হয়।
মৃত্তিকা ক্ষয়: মৃত্তিকা ক্ষয় ভূমি অবক্ষয়ের একটি প্রধানতম কারণ। সচরাচর দেখা যায় মৃত্তিকা ক্ষয়ের প্রক্রিয়াটি খুব ধীর, বছরে হয়ত ১ মিলিমিটার। যার ফলে কৃষক এর প্রতি তেমন নজর দেন না। কিন্তু ২৫ বছর পর দেখা যায় ২৫ মিলিমিটার বা ১ ইঞ্চি মাটি ক্ষয় হয়ে গেছে। ক্ষতিটা যখন নজরে আসে ততক্ষণে ভূমি অনেক খানি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে ১ ইঞ্চি মৃত্তিকা তৈরি হতে প্রায় ৫০০ বছর সময় লাগে। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অমৎরপঁষঃঁৎধষ ৎবংবধৎপয ২০০০ এর গবেষণা মতে মৃত্তিকা ক্ষয়, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারণে বিশ্বের ৪০ শতাংশ কৃষি জমির অবক্ষয় ঘটেছে যার কারণে বিশ্ব উৎপাদন ১৬ শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে। মরুকরণ ১০০ টি দেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৩.৫ কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। চিরসবুজ পৃথিবী ক্রমান্বয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে।
ভারসাম্যহীন কৃষিকাজ: প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে আবাদি জমি অনাবাদি খাতে হ্রাস পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে এ স্বল্প আবাদি জমি থেকেই। কৃষির এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রুপান্তর করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি উন্নতজাতের ফসল আবাদ করতে গিয়েও জমির উপর চাপ পড়ছে। সে কারণে জমির উৎপাদন ক্ষমতা চিন্তা করে জমিকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া শস্য পর্যায় অবলম্বন করা হয় না এতে মাটির উর্বরতা কমে যায়। আর মাটির উর্বরতা কমে গেলে মাটির ভূপ্রকৃতি বা পরিবেশের উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।

বন নিধন: বন উজাড় করনের কারণে মাটির উপরি স্তরের উর্বর মাটি অপসারিত হচ্ছে। আমাদের দেশে পাহাড়ি এলাকায় গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। এতে মাটির জৈব পদার্থের ঘাটতি হয়। অন্যদিকে বায়ুপ্রবাহ ও প্রচন্ড রোধে বা বৃষ্টিতে ভূমি ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। ফলশ্র“তিতে মাটির উর্বরতা মান কমে যায় এবং মাটির প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্ট হয়। এতে জীববৈচিত্র হারিয়ে যায়। অনেক প্রাণি, গাছ ও লতাপাতার বাস্তুসংস্থান হারিয়ে যায়।
উর্বর জমির মাটি ইট ভাটায় ব্যবহার: প্রতি বছর জনসংখ্যার বৃদ্ধি পাচ্ছে সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরায়ন। নগরায়নের ফলে আবাদি জমি অনাবাদি খাতে হ্রাস পাচ্ছে। অনেক উর্বর জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে। তাছাড়া অজ্ঞতার কারনে আবাদি জমির উপরিস্তরের মাটি ইট তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। আবার ঐ স্থানের আশেপাশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। গাছপালা মরে যায়,ফল ধরে না বা ঝরে পড়ে।
আবাদি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন হয়ে পড়ে বাড়তি ঘরবাড়ি,স্কুল কলেজ,শিল্প কারখানা ও রাস্তাঘাট নির্মানের। আর একারনে বাংলাদেশে প্রতিদিন এক শতাংশ হারে অর্থাৎ ২২২ হেক্টর করে আবাদি জমি অনাবাদি খাতে চলে যায়। এতে মাটির উর্বরতা হারায় বা মাটির অবক্ষয় হয়। এর ফলে মাটির ভূপ্রকৃতি বা পরিবেশ নষ্ট হয়।
এছাড়াও প্রতি বছর মৃত্তিকা ক্ষয়, নগরায়ণ, রাস্তাঘাট, খনিজ কর্মকাণ্ড,জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি খরা প্রভৃতিতে বিশ্ব হতে প্রায় ২ কোটি হেক্টর উর্বর ভূমি হারিয়ে যাচ্ছে।
আশার কথা হলো ভূমি উর্বরতা হ্রাস বন্ধ করা না গেলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেসব কৌশল মেনে চললে সহজে মাটির উর্বরতা রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলো –
জমিতে লবনাক্ত পানি প্রবেশ ঠেকাতে বাধ দেয়া, অনুমান ভিত্তিক রাসয়নিক সার প্রয়োগ না করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা, জমিতে প্রচুর পরিমানে জৈব সার ব্যবহার করা, উর্বর জমির মাটি ইট ভাটায় ব্যবহার না করা, পশুচারণ কমিয়ে দেয়া,পশুচারণের জন্য পরিবেশবান্ধব তৃণ বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বেশি করে লাগানো,বৃক্ষ নিধন কে কমিয়ে আনা এবং প্রাকৃতিক বনভূমিকে সুরক্ষা করা,সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধি করা,যে সব গাছ বা ঘাস মৃত্তিকার উর্বরতা ও পানিধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে, সে সব উদ্ভিদের বাগান সৃষ্টি করা।
পরিশেষে, নির্মল প্রকৃতি ও সবুজ শ্যামল ও ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর জন্য দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা। এ সংকট হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগ যেমন দরকার, তেমনি দরকার রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও পারস্পারিক সহযোগিতার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *