কৃষিবিদ ড. এম. এ. মান্নান
প্রিয় কৃষক ভাই, মধুমাসের শুভেচ্ছা নিন। এ মাসের মৌসুমী ফল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ হরেক রকম ফলের সুঘ্রাণে চারিদিকে মৌসুমী করে। একই সাথে পাকা বোরো ধান শোভা ছড়ায় পল্লীর মাঠে মাঠে। তবে জ্যৈষ্ঠের খরতাপ এবং ঝড়-বাদলের আশঙ্কাও কৃষকদের ভাবিয়ে রাখে সর্বসময়ই তবুও মধু মাসের আনন্দের জোয়ারে ভাসি আমরা সবাই। মধু মাসের শুভেচ্ছা জানিয়েই শুরু করছি এ সময়ে কৃষিতে করণীয় সম্পর্কে। ফল দিয়ে শুরু করলে ভাল হত। তবুও ধান দিয়ে শুরু করছি।
ধান
ইতিমধ্যেই বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। বোরো ধান কাটার পর মাড়াই-ঝাড়াই করতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে পারেন। আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে তাড়াতাড়ি ধান কেটে ফেলুন। অন্যথায় হঠাৎ ঝড় বা শিলা বৃষ্টির কারণে পাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। ধান কাটার পর ‘ব্রি ওপেন ড্রাম পাওয়ার থ্রেসার’ যন্ত্র দিয়ে অতি সহজে ধান মাড়াই করতে পারেন। এ যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় ১০ মণ ধান মাড়াই করা যায় এবং তিনজন শ্রমিক একসাথে কাজ করতে পারেন। ব্রি ধান-গম পাওয়ার থ্রেসারের সাহায্যেও ধান মাড়াই করা যায় এটি দিয়ে ঘণ্টায় ২৫ মণ ধান মাড়াই করা যায়। এতে দুজন শ্রমিক এক সাথে কাজ করতে পারেন। জ্বালানির প্রয়োজন হয় ঘণ্টায় এক লিটার। ধান মাড়াই বা পরিষ্কার করার জন্য আপনি ‘ব্রি পাওয়ার উইনোয়ার’- এর সাহায্য নিতে পারেন। এ যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় ১২ মণ ধান ঝাড়াই করতে পারবেন যা চালাতে দুজন শ্রমিক লাগবে। ধান শুকাতে রোদের প্রয়োজন। তবে ‘ইরি-ব্রি ড্রায়ার’ যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই ধান শুকানো যায়। শুকানো ধানের আর্দ্রতা ১২% এর বেশি যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। শুকনো ধান সতর্কতার সাথে গোলাজাত করুন।
নিচু জমিতে বোরো ধান চাষ করে থাকলে সেসব জমির ধান কাটার পরে জলি আমন ধানের চাষ করা যেতে পারে। এজন্য জলি আমন অর্থাৎ বোনা আমনের বীজ বোরো ক্ষেতে ছিটিয়ে বুনে দিন। এতে বিনা পরিশ্রমে অতিরিক্ত একটি ফসল পেয়ে যাবেন। কারণ নিচু জমি বর্ষায় ডুবে থাকে বলে অন্য কোনো ফসল চাষ করা যায় না অথচ জলি ধান বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে বাড়ে।
এ সময় আউশ ধানের চারা রোপণ করা যায়। বৃষ্টি হলে জমিতে চাষ দিয়ে আউশের চারা রোপণ করতে পারেন। বৃষ্টি না হলে জমি তৈরির জন্য সেচ দিয়ে নিন। চারার বয়স ১২-১৫ দিন হলে ইউরিয়ার উপরি প্রয়োগ না করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে পারেন। এতে গুঁড়া ইউরিয়ার চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ খরচ কম। আবার ফলনও হয় বেশি। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের জন্য প্রতি চার গুছির মাঝখানে ১টি করে গুটি আঙুলের চাপে কাদা মাটিতে পুঁতে দিন। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পর বেশ কিছু দিন জমির মাটি নাড়াচারা করতে হয় না বলে ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত জমিতে না নামাই ভালো।
এ সময় আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরি পোকার আক্রমণ হতে পারে। পামরি পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ধান গাছের ব্যাপক ক্ষতি করে। পোকার আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে হাতজাল দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের আগা কেটেও এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ ব্যাপক হলে অর্থাৎ প্রতি গুছিতে ৪টি বয়স্ক পোকা বা প্রতি পাতায় ১৫টি কীড়া পাওয়া গেলে অথবা জমির শতকরা ৩৫টি পাতা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
আর কদিন পরেই আসবে রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরি করার সময়। বীজতলার জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করুন যেখানে সূর্যের আলো পড়ে নিয়মিত। নির্বাচিত জমিতে ভালোভাবে চাষ দিয়ে কাদা কাদা করা জমিতে মই দিয়ে সমান করুন। ১২০ সেমি. বা ৪ ফুট চওড়া এবং জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করে বীজতলার বেড তৈরি করে নিন। প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য বেডের চার পাশে ৪৫ সে.মি. বা দেড়ফুট চওড়া নালা রাখা দরকার। জমির উর্বরতা বাড়াতে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈব সার জমি তৈরির সময় দেয়া যেতে পারে। বীজ বোনার আগে বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে দিলে চারা তোলার সময় সুবিধা হয়। এবার জানিয়ে দেই রোপা আমনের উন্নত কয়েকটি জাতের নাম। এগুলো হলো- বিআর-৩, বিআর-৪, বিআর-৫, বিআর-১০, বিআর-২২, বিআর-২৩, বিআর-২৫, ব্রিধান-৩০, ব্রিধান-৩১, ব্রিধান-৩২, ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৪, ব্রিধান-৩৭, ব্রিধান-৩৮, ব্রিধান-৩৯, ব্রিধান-৪০, ব্রিধান-৪১, বিনাশাইল ইত্যাদি। স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে আপনার এলাকার উপযোগী জাত ব্যবহার করুন।
পাট
জমিতে এ সময় আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া জমিতে চারা ঘন হলে সুস্থ ও সবল চারা রেখে অন্যান্য চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। বৃষ্টির কারণে পাট ক্ষেতে পানি জমে গেলে পানি বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। ফান্ডুনী তোষা পাটের বয়স দেড় মাস হলে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করুন। এ সময় পাটে বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমণ হতে পারে। এরা গাছের পাতা ও ডগা খেয়ে ফেলে। পাট ক্ষেতে বাঁশ বা গাছের ডাল পুঁতে পাখি বসার সুযোগ করে দিলে পাখি পোকা খেয়ে ফেলবে। এতে পোকার আক্রমণ কমবে। আক্রমণ খুব বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
শাকসবজি
এখন গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা করা বিশেষ জরুরি। সতর্কতার সাথে শাকসবজির জমিতে সারের উপরি প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজি মাচায় তুলে দেয়ার কাজ করতে হবে নিয়মিত। পাতাজাতীয় সবজির বাড়-বাড়তি বেশি হলে কিছু কিছু লতা বা পাতা কেটে ছাঁটাই করে দেয়া দরকার। এতে তাড়াতাড়ি এবং বেশি বেশি ফল পাওয়া যাবে। শাকসবজির রোগ ও পোকা দমনের জন্য এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেসব বালাইনাশকের বিশেষ বিশেষ প্রভাব ৩-৪ দিনের বেশি থাকে সেসব বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না। কুমড়া জাতীয় সবজির ক্ষেত্রে অধিক ফলন পেতে কৃত্রিম পরাগায়ন করুন।
অন্যান্য ফসল
আমরা ধান উৎপাদন করতে গিয়ে ডাল ও মসলা জাতীয় ফসলের উপর খুব একটা নজর দিচ্ছিনা। আদা ও হলুদ চাষে আমাদের আরও আগ্রহী হতে হবে। আদা ও হলুদ চাষের পদ্ধতি প্রায় কাছাকাছি। ডিমলা হলুদ এবং পাহাড়ী আদা চাষ বেশ লাভজনক হবে। মসলা জাতীয় ফসল চাষের ক্ষেত্রে ২% হারে কৃষি ঋণ পাবার সুযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে কৃষক ভাইরা স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে যোগাযোগ করতে পারেন।
আমাদের মাটিতে জৈব সারের পরিমাণ কম, তাই জমিতে জৈবসারের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য সবুজ সার চাষ করতে হবে। ধৈঞ্চা বা শনপাটের আবাদ করুন। এ সব সবুজসার ফসলের বয়স ৩৫-৪০ দিন হলে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
কচু অত্যন্ত উপকারী সবজী, লতিরাজ কচুর চাষ করে উপকৃত হওয়া যায়। লতিরাজ বা অন্য কোন কচুর চাষ করুন।
গাছপালা
গাছপালায় বছরে দুবার সার প্রয়োগ করতে হয় বর্ষার আগে একবার এবং বর্ষার পরে একবার। বর্ষার আগে এখনো গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ না করে থাকলে দ্রুত সার প্রয়োগের ব্যবস্থা নিন। গাছের গোড়ার চারদিকের মাটি ভালো করে কুপিয়ে পরিমাণমত জৈব ও রাসায়নিক সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। ফল গাছের চার পাশে গাছের বয়স অনুযায়ী প্রতি বৎসরের জন্য ২টি সিলভামিক্স গর্ত করে ৬ ইঞ্চি নিচে পুতে দিতে হবে। নতুন করে বনজ, ওষুধি বা ফল গাছের চারা রোপণ করতে চাইলে নির্ধারিত স্থানে গর্ত করে জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখুন। ৭-১০ দিন পর চারা রোপণের কাজ শুরু করুন।
পশুপাখি পালন
বর্ষার আগে গবাদি পশুর গোয়াল ঘর সংস্কার করুন এবং ঘরের আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করুন। বর্ষায় যাতে পশু-খাদ্যের সংকট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে পশুর খাদ্য সংরক্ষণ করুন। বর্ষার আগে অবশ্যই গরু বাছুরের টিকা দেয়া উচিত। আপনার গরু-বাছুরকে নিয়মিত গোসল করান এবং ঠান্ডা স্থানে রাখুন। হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রে নিয়মিত ভ্যাক্সিন দিয়ে নিন এবং সুষম খাদ্য পরিবেশন করুন। উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে গিয়ে এসব বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিন।
মাছ
মাছ চাষের জন্য যারা হ্যাচারি করেছেন এবং ডিম থেকে পোনা করবেন তারা এ সময় বিশেষ সতর্ক থাকুন। কারণ এ সময় মাছের প্রজনণের সময়। আঁতুর পুকুরের পোনা আঙুলের সমান লম্বা হলে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিন। বর্ষার আগে পুকুর পাড়ের সংস্কার করে নিন। প্রয়োজনে উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে পরামর্শ নিন।
প্রিয় পাঠক, এ সময়ে আপনার ঘরে যেমন আম-কাঁঠাল খাওয়ার ধুম লাগে তেমনি মাঠে থাকে কৃষি কাজের ব্যস্ততা। এ ব্যস্ততা ফসল এবং গৃহপালিত পশু-পাখি ও মাছ চাষকে ঘিরে। কৃষি কাজের নানান বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন আপনার পাশের কৃষিকর্মীর সাথে, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে অথবা ফোন করুন- ০১৯১৫৪৭৩৩০৮ এই নাম্বারে। সকলের ব্যস্ত সময়ে লাগুক মধুমাসের আনন্দের পরশ। এ প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি এ সময়ের কৃষি।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম