নিতাই চন্দ্র রায়ঃ
নাটোরের নলডাঙ্গা হাটে বর্তমানে পটল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা মণ দরে । তারপরও বিক্রয়ের জন্য ক্রেতা পাচ্ছে না কৃষক । অনেকে অভিমান করে বাজারের ভাগাড়ে ফেলে চলে যাচ্ছে পটলের মতো পুষ্টিকর সবজি । কিছুদিন আগেও এই পটল বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে । বগুড়ার সোনাতলায় ২ টাকা কেজি দরে ঢেড়স ও মহাস্থানগড়ে ২ টাকায় একটি লাউ বিক্রির খবরও আমারা পেয়েছি স্থানীয় সংবাদ- পত্রের বদৌলতে । যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ১৬ কোটি মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি পণ্য উৎপাদন করে, সে যখন পণ্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারে না,তখন জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? কৃষক শুধু সবজি বিক্রি করেই লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন তা নয় ; বোরো ধান, গম কখনো কখনো আ্লু বিক্রি করেও তাকে মোটা অংকের লোকসান গনতে হচ্ছে । লোকসান যেন কৃষকের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে । ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করছে । সে এক ফসল ছেড়ে অন্য ফসলে গেলেও লোকসান তাঁর পিছু ছাড়ে না । কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের এক পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেছেন, কৃষক যাতে উৎসাহ না হারায় সে লক্ষ্যে ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে ।মনে রাখতে হবে কৃষকের মঙ্গলের জন্য ফসল যেমন দরকার , তেমনি ভাল দামও একান্ত প্রয়োজন । চাউলের দাম কম থাকলে আমারা সবাই খুব খুশি হই । কিন্তু যারা কষ্ট করে চাল উৎপাদন করে তাঁদের কথা কি আমারা কখনো ভেবে দেখি ? আমারা বলি কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে । দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচবো ।জাতি এগিয়ে যাবে কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে ।এসব কথা এখন সর্বস্বান্ত কৃষকের কাছে একেবারে মূল্যহীন ।এখনও বাংলাদেশে শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নিরভরশীল । জনশক্তির শতকরা ৪৫ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত । জিডিপির শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ আসে কৃষি থেকে ।অধিকাংশ শিল্পের কাঁচা মালের প্রধান উৎস হলো কৃষি । জাপান, কোরিয়া ও চীন এক সময় কৃষি নির্ভর স্বল্প আয়ের দেশ ছিল । কৃষিকে কেন্দ্র করেই আজ তারা উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে । জাপানী প্রধানমন্ত্রী এখনও তা অপকটে স্বীকার করেন ।পণ্যের ন্যায্য মূল্য ছাড়াও কৃষির সামনে রয়েছে নানা রকমের চ্যালেঞ্জ । এরকম একটি ছোট্ট ভূখণ্ড থেকে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবরতন জনিত প্রভাবের কারণে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা, যেখানে জনসংখ্যা বাড়ছে প্রতিবছর ১.৩৬ % হারে আর কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে শতকরা একভাগ হারে । জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে এদেশের কৃষি ও কৃষক । চৈত্র মাসের শেষের দিকে হঠাৎ অতি বৃষ্টির কারণে গত বছর উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার একর জমির মসুর , গম, রসুন ও পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায় । আগের বছর বিঘায় যেখানে ৫ মণ মসুর ফলেছে , গতবছর সেখানে বিঘায় মসুর হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ কেজি ।বৈরী আবহাওয়ার কারণে গেল বছর গমের ফলন এতই কম হয়েছে যে অনেক কৃষক গম কাটার জন্য মাঠেই যান নি । বৃষ্টির কারণে অনেকের রসুন ও পেঁয়াজ মাটির নিচে পচে নষ্ট হয়ে যায় । জলবায়ুর পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবেলার জন্য আমাদের কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে । ঘাত সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনে বেশি নজর দিতে হবে ।পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে এবং সেগুলু দ্রুত বিস্তারের ব্যবস্থা নিতে হবে ।জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে উৎপাদিত শাক-সবজি ও ফল-মূলের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ নষ্ট হয় প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে ।মৌসুসের সময় দেশে এক কেজি আলু বিক্রি হয় ৫ থেকে ৬ টাকায় । অথচ এই আলু যখন প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তখন ৫০ গ্রাম চিপস বিক্রি করা হয় ১০ থেকে ১৫ টাকায় ।একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য প্রক্রিয়াকৃত গুড়া হলুদ, গুড়া মরিচ , গুড়া ধনে, হালিম মিকচার, খিচুরি মিকচার, পাপড়, চানাচুরসহ সকল কৃষি পণ্যের বেলায় । কৃষিপণ্য প্রকিয়াকরণে অনেক সুবিধা আছে । প্রকিয়াকরণকৃত পণ্যে মূল্য সংযোজন হয় বেশি । কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায় ।অসময়ে শাক-সবজি ও ফলমূলের স্বাদ উপভোগ করা যায় । প্রক্রিয়াকরণকৃত কৃষি পণ্য বহুদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায় ।এ জন্য দেশের উত্তরাঞ্চলে একাধিক কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে ।থাইল্যান্ডে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই প্রক্রিয়াকরণ করা হয় ।
বর্তমানে কৃষির আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো- কৃষি শ্রমিকের অভাব ।ফসল উত্তোলন কালে কৃষি শ্রমিকের অভাবে অনেক সময় পাকা শস্য কৃষক ঘরে তুলতে পারেন না ।বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বিনষ্ট হয়ে যায় । আবার শ্রমিকের স্বল্পতার কারণে কৃষক সময় মতো শস্য রোপণ ও আন্তঃপরিচর্যার কাজগুলো সম্পাদন করতে পারেন না । এতে কাঙ্ক্ষিত ফলন থেকে বঞ্চিত হন কৃষক ।শ্রমিক স্বল্পতার কারণে দিন দিন কৃষি শ্রমিকের মজুরী বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে ।বোরা ধান কাটার সময় ৫০০ টাকা দিয়েও একজন কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না । আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পরযন্ত কৃষি শ্রমিকেরা কাজ করতো মাঠে । কৃষি শ্রমিকেরা এখন সকাল আটটায় কাজ শুরু করে এবং বেলা একটায় কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায় ।এতে একজন শ্রমিক দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করে না । রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও কুড়িগ্রাম, নীলফামারীতে মহিলা শ্রমিকেরাই বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষি । তাঁরা না থাকলে অনেক আগেই উত্তরাঞ্চলে কৃষি কাজ বন্ধ হয়ে যেতো । শ্রমিকেরা এখন ইটভাটা, মাটি কাটা, ভ্যান , রিক্সা চালানো, নির্মাণ কাজ রংমিস্ত্রির কাজে তুলনামূলকভাবে বেশি টাকা উপার্জন করে । ফলে তাঁরা কৃষি শ্রমিকের কাজ করতে চায় না । তাঁদের কথা- কৃষি কাজে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, মজুরী কম এবং কোনো সম্মানও নেই । কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতার কারণে অনেক বড় বড় কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে জমি লীজ দিয়ে শহরে বসবাস করছেন ।যারা জমিতে নিজেরা শ্রম দিতে পারেন এখন কৃষি কাজ তারাই করছেন ।কৃষি শ্রমিকের সংকট মোকাবেলা করতে হলে আমাদের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে ।বর্তমানে শতকরা ৯০ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে কলের লাঙ্গলে । ধান, গম কাটার কাজেও দেশের কোনো কোনো স্থানে কম্বাইন হারভেষ্টার ও রিপারের যৎসামান্য ব্যবহার দেখা যায় । আমন ও বোরো ধানের আগাছা দমনে হ্যান্ড উইডারও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ।এ ছাড়া ধান, গম, ডাল , তেল শস্য ও আখ মাড়াই কাজে দেশে উদ্ভাবিত মাড়াইযন্ত্রগুলো সফলতার সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে ।কৃষি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে কৃষিকে লাভজনক করতে হলে আমাদের ফসল রোপণ, আন্তঃপরিচর্য়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাজাতসহ সকল কাজে যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে ।এ জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করে নয়; আমাদের মাটি, আবহাওয়া, কৃষকের আর্থিক অবস্থা , ফসলের ধরন , খণ্ডখণ্ড জমির অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সাশ্রয়ী দামের দেশীয় কারখানায় প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার কৃষি খাতের উন্নয়নকে বেশ প্রভাবিত করছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কৃষক এখন ঘরে বসেই জানতে পারে তার পণ্যের বাজার দাম । জানতে পারে বিভিন্ন ফসলের সারের সুষম মাত্রা ।পোকা-মাকড়-রোগবালই দমনের আধুনিক কলা-কৌশল ।মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে আখ চাষিরা পাচ্ছে পুর্জি প্রাপ্তির আগাম সংবাদ । গত বছর জয়পুরহাট চিনি কলে আখ চাষিদের মোবাইল ব্যাংকিংএর মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে আখের মূল্য । কৃষককে ফসলের নায্যমূল্য দিতে ও পাট ক্রয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে চলতি মৌসুম থেকে এসএমএসের মাধ্যমে পাট কিনবে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। শুধু তাই নয়, কৃষককে তার পাট বিক্রির অর্থও পরিশোধ করা হবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে পৃথিবী এখন চলে এসেছে কৃষকের হাতের মুঠোয় ।কৃষকরা যাতে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারেন সেজন্য তাদেরকে কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে । সেই সাথে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে তথ্যপ্রযুক্তির ফলে উদ্ভাবিত সুবিধাকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে । কৃষি এখন আর খোরকী ও গ্রামের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই । ক্রমে এটি বাণিজ্যিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ্ । এগিয়ে যাচ্ছে নগরীয় কৃষির দিকে । বিশ্বায়ণ কৃষির এই রূপান্তর প্রক্রি ও গতিশীল করে তুলেছে ।কৃষি শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ শক্তিই নয়; নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ।এ কথাটি মনে রেখে কৃষির ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করাসহ কৃষির কঠিন চ্যালেঞ্জকে আমাদের সীমিত সম্পদ , সাহসিকতা , বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে ।কারণ কৃষিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম