“প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত বাগান ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করা প্রায় অসম্ভব। আম রপ্তানির কথা মাথায় রেখে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি নিয়ে আমের বিভিন্ন জাতের উপর জোরদার গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফলাফল মিলেছে হাতেনাতেই এবং আমের রপ্তানি শুরু হয়েছে গত বছরই। গত মৌসুমে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে আমের মাছি পোকাটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে শেষের কয়েকটি চালান নিজ দায়িত্বে নষ্ঠ করেছেন আম রপ্তানিকারকেরা। কিন্তু এটি মোটেই কাঙ্খিত নয়। এই একটি পোকার উপস্থিতিই যথেষ্ঠ্য আম রপ্তানি বন্ধ হওয়ার জন্য। শুধুমাত্র ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমের মাছি পোকা শতভাগ দমন করা সম্ভব। আশাকরছি সংশ্লিষ্ঠ্য সকলে এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।”
আমের রপ্তানি বিষয়টি এদেশের আম চাষীদের নিকট একেরারেই নতুন। আমের রপ্তানি শুরু হওয়ার পর অনেক আমচাষী চেষ্টা করেছেন তার বাগানের আম রপ্তানির জন্য। তাদের ধারণা প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম রপ্তানি করা যাবে। প্রকৃতপক্ষে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে আম সংগ্রহ করার পর থেকেই। এদেশে জন্মানো সকল জাত রপ্তানিযোগ্য নয়। প্রথমেই আমাদের জানা দরকার কোন জাতগুলো রপ্তানি করা যাবে। হিমসাগর, খিরসাপাত, বারি আম-২ বা লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, বারি আম-৩ বা আম্রপালি, বারি আম-৭ ও আশ্বিনা জাতের আম সহজেই রপ্তানি করা যাবে। তবে ব্যাগিং প্রযুক্তিতিতে উৎপাদিত হাড়িভাঙ্গা আমটিকে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। অন্যান্য জাতগুলো বিভিন্ন কারণে রপ্তানি করা সম্ভব নয়।
তবে যে জাতই হোক না কেন আমগাছ হতে আম সংগ্রহের পর হতে বিভিন্ন পরিচর্যার প্রয়োজন। যেমন প্র“নিং, ট্রেনিং, সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা ও রোগ এবং পোকামাকড় দমন পদ্ধতি ইত্যাদি। আমগাছ হতে আম সংগ্রহ করার পর রোগাক্রান্ত বা মরা ডাল পালা একটু ভাল অংশসহ কেঁটে ফেলতে হবে। ডালপালা এমনভাবে ছাঁটাই করতে হবে যেন গাছের ভিতরের অংশে পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে। গাছের ভিতরমুখী ডালে সাধারণত ফুল-ফল হয় না, তাই এ ধরণের ডাল কেঁটে ফেলতে হবে। ফলে বর্ষাকালে কর্তিতঅংশগুলো হতে নতুন কুশি জন্মাবে এবং পরের বছরে এই নতুন কুশিগুলোতে ফুল আসবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে ডগার বয়স ৫-৬ মাস না হলে ঐ ডগায় সাধারণত: ফুল আসেনা। আগামী বছরে একটি গাছে কি পরিমান ফলন হতে পারে তা আগষ্ট মাসেই ধারণা পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে গাছে যতবেশী নতুন ডগা বের করা যায় ততই উত্তম।
এরপর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে সার প্রয়োগ। আমবাগান হতে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সময়মত সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি গাছে প্রতি বছর কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পুষ্টি উপাদানের উপর। সব ধরনের মাটিতে সারের চাহিদা সমান নয়। সুতরাং মাটির অবস্থাভেদে সারের চাহিদা কম-বেশী হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। নিম্নে আমগাছের বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সারের পরিমান দেওয়া হলো ;
গোবর সার দিতে হবে রোপনের ১ বছর পর ২০ কেজি, রোপনের ২ বছর পর ২৫ কেজি, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ কেজি এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে প্রতিটি গাছের জন্য ১২৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ইউরিয়া রোপনের ১ বছর পর ২৫০ গ্রাম, রোপনের ২ বছর পর ৩৭৫ গ্রাম , প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১২৫ গ্রাম এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ২৭৫০ গ্রাম সার প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি রোপনের ১ বছর পর ১০০, রোপনের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ২১৫০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। এমপি রোপনের ১ বছর পর ১০০ গ্রাম, রোপনের ২ বছর পর ২০০ গ্রাম, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ গ্রাম এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ২১৫০ গ্রাম সার প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম রোপনের ১ বছর পর ১০০ গ্রাম , রোপনের ২ বছর পর ১৭৫ গ্রাম, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৭৫ গ্রাম এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ১৬০০ গ্রাম প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট রোপনের ১ বছর পর ১০ গ্রাম, রোপনের ২ বছর পর ১৫ গ্রাম ,প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ গ্রাম এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ১১০ গ্রাম প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। বোরিক এসিড রোপনের ১ বছর পর ০৫ গ্রাম , রোপনের ২ বছর পর ০৭ গ্রাম, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ০২ গ্রাম এবং ২০ বছর ও এর উর্দ্ধে ৫০-১০০ গ্রাম প্রতিটি গাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে কিছু অসাধু আম ব্যবসায়ী আম গাছে প্যাকলোবিউটাজল নামক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছেন যা কাঙ্খিত নয়। এটি ব্যবহারের ফলে আমগাছ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গাছ মারাও যেতে পারে।
সমস্ত সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভাল। প্রথম অর্ধেক বর্ষার আগে এবং বাকী অর্ধেক আশ্বিন মাসে অর্থাৎ বর্ষার পরে প্রয়োগ করতে হবে। যদি কোন আমচাষী প্রথম কিস্তিতে সার প্রয়োগ না করে থাকেন তবে অবশ্যই দ্বিতৃীয় কিস্তিতে চাহিদার পুরোটাই প্রয়োগ করতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর বৃষ্টি না হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক আমচাষী বাগানের ফজলি ও আশ্বিনা আম সংগ্রহ করার পর সার প্রয়োগ করেন যা মোটেই বিজ্ঞান সম্মত নয়। ফলন্ত গাছে গুড়ি থেকে ২-৩ মিটার দুরুত্বে ৩০ সেন্টিমিটার প্রশস্থ ও ১৫-২০ সেন্টিমিটার গভীর করে চক্রাকার নালা কেঁটে নালার ভেতর রাসায়নিক ও জৈব সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অথবা দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় সার ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সাধারণত আমগাছে ফল আসার পর গাছগুলো দুর্বল হয়ে থাকে। ফলে গাছের প্রয়োজন হয় খাদ্যের। সার দেওয়ার পর বর্ষা আরম্ভ হলে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য মাটি থেকে নিতে থাকে। ফলে গাছে নতুন পাতা বের হয়। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় অনেকেই আমবাগানে প্রতিবছর সার প্রয়োগ করেন না অথবা দেরীতে সার প্রয়োগ করে থাকেন। ফলে তারা আশানুরূপ ফলন পাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, জুন-আগষ্ট মাসে আমগাছে যতবেশী নতুন পাতা বা ডগা বের হবে ততই উত্তম কারণ পরবর্তী বছরে এই সমস্ত ডগায় ফুল আসার সম্ভাবনা বেশী থাকে। ফলে আমের ফলন বৃদ্ধি পাবে।
সার প্রয়োগের পর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। খরা মৌসুমে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের প্রয়োজন পড়ে না। গবেষণা করে দেখা গেছে আম গাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাৎ গাছের গোড়ার চারিদিকে ১ মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মতো করে বেসিন তৈরী করে সেচ প্রয়োগ করলে সেচে পানির পরিমান কম লাগে এবং গাছ বেশীর ভাগ পানি গ্রহণ করতে পারে। বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ প্রয়োগকৃত জায়গা কচুরিপানা দ্বারা ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে আম চাষাবাদের জন্য মালচিং প্রযুক্তিটি ব্যবহার করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেওয়া উত্তম। কারণ কোন কোন সময় দেখা গেছে, এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হয় ফলে মুকুলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করা যেতে পারে ফলে বাগানে জৈব পদার্থ সহ অন্যান্য সার যোগ হবে এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
রোগাক্রান্ত ও পোকায় আক্রান্ত আম রপ্তানি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই রোগ ও পোকামাকড় অবশ্যই দমন করতে হবে তবে তা অবশ্যই যথাযথ নিয়মে ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে। রপ্তানিযোগ্য আমে অতিরিক্ত বালাইনাশকের ব্যবহার মোটেই কাম্য নয়। অনেকে মনে করতে পারেন বালাইনাশক অতিরিক্ত ব্যবহার করলে তা বুঝার কোন উপায় নেই। আসলে বিষয়টি ঠিক নয়। উপযুক্ত প্রমান ছাড়া আম রপ্তানির জন্য নির্বাচন করা হয় না। আমের জন্য তিন বার স্প্রে করা জরুরী। প্রথমবার মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে, দ্বিতীয়বার মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে এবং শেষবার আম মটর দানাকৃতি হলে। এরপর ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ভাল মানের রপ্তানিযোগ্য আম পাওয়া যাবে। ব্যাগিং করার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে যা অবশ্যই মানতে হবে। আমের গুটি বাধার ৪০-৫৫ দিন পরে ব্যাগিং করলে সবচেয়ে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। তবে ফজলি ও আশ্বিনা জাতে গুটির বয়স ৬৫ দিন পর্যন্ত ব্যাগিং করা যাবে। যে কোন জাত পরিপক্ক হবার ৭ দিন পূর্বে ব্যাগ খুলে দেখতে হবে। অথবা সংশ্লিষ্ঠ্য গবেষকের সাথে পরামর্শ করে আম সংগ্রহ করতে হবে। রপ্তানির আম সংগ্রহ করা হয় তুলনামুলকভাবে কয়েকদিন পূর্বে তবে আমটি অবশ্যই পুষ্ঠ হতে হবে। কারণ রপ্তানিযোগ্য আমের সংরক্ষণকাল বেশি হলে ভাল হয়। পাকা আম কোন ভাবেই রপ্তানির জন্য উপযুক্ত নয়। আম সংগ্রহ হতে শুরু করে প্যাকিং, পরিবহনে আম যেন কোন আঘাত না পায় সেই দিকে বিশেষ মনযোগ দিতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে রপ্তানি একটি দেশের জন্য সম্মান, কারও কোন অসাধু তৎপরতাই যেন এটি বন্ধ না হয় সেই বিষয়ে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে। তবেই আমাদের দেশের আম রপ্তানির ধারা অব্যহত থাকবে।
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাই নবাবগঞ্জ