কৃষিবিদ মোঃ সিরাজুল ইসলাম
নারকেলের নানা ধরনের ব্যবহার
নারকেল শুধু উপাদেয় খাদ্য বা তেলের উপাদানই নয়। এর দ্বারা শারিরীক বিভিন্ন রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। নারকেলের উচ্চ ভেষজগুণ থাকায় অনেক বছর থেকেই ত্বক ও চুলের পরিচর্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, এতে আছে- ভিটামিন, মিনারেল, ইলেকট্রোলাইড, অ্যামিনো এসিড। এ ছাড়া আছে ছত্রাক বিরোধী (অ্যান্টি ফাঙ্গাল) উপাদান, অ্যান্টি বায়োটিক ও অ্যান্টি ভাইরাল, যা ত্বকের সংক্রমণ দূর করে। এর মধ্যে আরো আছে ভিটামিন সি, বি-১, বি-৫, বি- ৬, আয়রন ও প্রাকৃতিক লবণ। তাই এ কথা বলা যায় যে, ভেষজগুণে নারকেলের জুড়ি মেলা ভার। নিম্মে নারকেলের রোগ নিরাময়ে প্রয়োগ ও ব্যবহার তুলে ধরছি।
০১. ডায়াবেটিস নিরাময়ে ঃ ডায়াবেটিসের মাত্রা যদি অনেক বেড়ে যায়, এক্ষেত্রে একটি কচি ডাবের মুখ ফুটো করে তাতে দুই চিমটি পরিমাণ কালোজিরা রাতে ঐ ডাবের পানিতে দিয়ে রাখবেন। পরের দিন সকালে খালি পেটে পুরো ডাবের পানি কালোজিরাসহ খাবেন। এরূপ পদ্ধতিতে দেড়-দুই সপ্তাহ খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তারপর মাঝে মাঝে খেলেই চলবে।
০২. অজীর্ণ রোগে ঃ ঝুনো নারকেলের আাঁস বের করে বেটে পানিতে গুলে ছেঁকে সেই পানি জ্বাল করে টাটকা তেল তৈরি করে রেখে দিন। প্রতি বার ভাত খাওয়ার সময় প্রথমেই ১ চা-চামচ তেল ভাতে মেখে খেলে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে উক্ত রোগ সেরে যাবে। এছাড়াও প্রতিবার ১ চামচ তেলের সাথে ৫টি পূঁদিনার মাথার ডাল পাতাসহ ছোট করে কেটে খেলে নিশ্চিত এ রোগ দূর হবে।
০৩. মুত্রকৃচছতায় ঃ অজীর্ণ জনিত কারণে, অত্যধিক রৌদ্রে ঘোরায়, অত্যধিক পরিশ্রমে অথবা একনাগাড়ে এক আসনে চেপে বসে থাকায় যে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা আসে, এক্ষেত্রে একটা বা দুইটা ডাবের পানি খেলে সাময়িক ঐ অসুবিধা চলে যাবে।
০৪. প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধিতে ঃ এক্ষেত্রে নারিকেল গাছের কচি শিখড় ছেচে রস করে সকালে এক চা-চামচ ও বিকালে এক চা-চামচ একটু কুসুম গরম দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। ৭-৮ দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য উপকার পাওয়া যাবে। তবে একেবারে নিরাময়ের জন্য আরও কিছুদিন খেতে হবে।
০৫. ক্রিমিতে ঃ খাবার গ্রহণের পর একেবারে প্রাথমিক দিকের কচি ডাবের পানি যার স্বাদ লবণাক্ত ও কষাক্ত, মিষ্টি হলে একেবারেই চলবে না। তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। খেতে হবে ৭/৮ দিন।
০৬. দাঁতের মাড়ি ফোলায় ঃ দাঁতের গোড়ায় যন্ত্রণা হচ্ছে, এক্ষেত্রে নারিকেলের শিকড় পুড়িয়ে ছাই করে সেটাকে মিহি গুঁড়ো করতে হবে; ছেঁকে নিয়ে সেটা দিয়ে আস্তে আস্তে দাঁত মাজতে হবে। কয়েকদিন মাজলে দাঁতের ফুলা সেরে যাবে।
০৭. কোষ্টবদ্ধতায় ঃ প্রতিদিন সকালে একেবারে খালি পেটে এক কাপ করে ঝুনো নারিকেলের পানি ১০/১২ দিন খেলে কোষ্ঠবদ্ধতা চলে যাবে।
০৮. দাদে ঃ রিং (গোল) দাদ যেগুলো গোল হয়ে বড় হতে থাকে, চারধারে ছোট দানার মতো দৃষ্টি গোছর হয়। সে ক্ষেত্রে ঝুনো নারিকেলের মালায় আগুণ লাগিয়ে একটা পাথর বাটির মধ্যে পুরে একটা ডিক্স দিয়ে চাপা দিয়ে নির্গত ঘামটা ধরে নিতে হবে। তারপর এগুলো তুলিতে করে কেবলমাত্র ঐ দাদের জায়গায় লাগাতে হবে। এটা লাগালে বেশ জ্বালাও করবে এবং ঐ জায়গাটা পুড়েও যাবে; তারপর আবার ২-৩ দিন লাগাবেন না। এ সময় দাদের জায়গাটিতে শুধু নারকেল তেল লাগাবেন। হয়ত আরো একবার লাগাতে/লাগানো প্রয়োজন হতেও পারে। আবার না লাগালেও অনেকের সেরে যায়।
০৯. আধ-কপালে মাথা ব্যাথায় ঃ এ রোগে নারিকেলের পানিতে ১০-১২টি দানা চিনি মিশিয়ে অল্প অল্প করে নাক দিয়ে টেনে অথবা ড্রপারে করে নাকে গলাধঃকরণ করতে হবে, ম্যাজিকের মাতা কাজ করবে।
১০. শুক্র তারল্যে ঃ ঝুনো নারকেলের ছোলা ফেলে দিয়ে মুখটা ছেঁদা করে পানিটা ফেলে দিয়ে তার ভেতরে খানিকটা লবণ ভরে, দু-একদিন মুখ বন্ধ করে রাখুন। এভাবে রাখার কারণে ভেতরের শাঁস বেশ নরম হয়ে যাবে। এরপর ভেতরে একটু পানি দিয়ে ধুয়ে নারিকেলের শাঁসটাকে চামচ বা ছুরি দিয়ে তুলে ফেলুন। শাঁসটাকে বেটে দুধ বের করে ছেঁকে নিন। নারকেলের এই দুধ দু চা-চামচ, আধ কাপ গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে রোজ সকালে ১০-১৫ দিন খেলে উল্লেখযোগ্য উপকার পাবেন।
১১. চুলের গোড়া শক্তকরণ ও বর্ধনে ঃ খাঁটি নারিকেল তেল নিয়মিত মাথায় মাখলে চুলের গোড়া শক্ত হয় এবং চুল দ্রুত বর্ধিত হতে থাকে।
১২. মুখে দানা বা কালো দাগে ঃ মুখে দানা বা কালো দাগ থাকলে প্রত্যেকদিন ডাবের পানি দিয়ে মুখ ধুলে এবং প্রচুর ডাবের পানি খেলে মুখের কালো দাগ সেরে যায় এবং দানা উঠাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাথে আরো একটি কাজ করা যেতে পারে- কিছু সোহাগা গুঁড়ো করে খোলায় দিয়ে ভেজে খৈ করে একটা খাঁটি নারকেল তেলের বোতলে দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এখন প্রতিদিন শোবার আগে ও ভোর বেলা সমস্ত মুখে মাখিয়ে নিন। এতে মুখের আর্দ্রতা ও মসৃণতা বৃদ্ধি পেয়ে সুন্দর লাগবে।
রুপ চর্চায় নারকেলের ব্যবহার ঃ নারকেলের বিভিন্ন প্যাক অনেক বছর আগে থেকেই ত্বক ও চুলের পরিচায় ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেই নয়, বরং চুলের সৌন্দর্য রক্ষায়ও সমানভাবে কাজ করে নারকেলের প্যাক। নারকেলে আছে ভিটামিন, মিনারেল, ইলেকট্রোলাইড, অ্যামিনো এসিড। হারমোনি স্পার বিশেষজ্ঞদের মতে উপরোক্ত উপাদান ছাড়াও আছে ছত্রাকরোধী অ্যান্টি ফাঙ্গল উপাদান, আ্যান্টিবোয়েটিক ও অ্যান্টিভাইরাস, যা ত্বকের সংক্রমণ দূর করে। এর মধ্যে আরও আছে ভিটামিন সি,বি-১, বি-৫, বি-৬,ই আয়রন ও প্রাকৃতিক লবণ। তাই এক কথায় বলা যায় যে রূপ চর্চায় নারকেল থেকে তৈরি দুধের জুড়ি মেলা ভার।
নারকেল দুধ তৈরির পদ্ধতি ঃ খাবার পানি গরম করুন। ঠান্ডা পানি মিশিয়ে পানিকে কুসুম গরম করুন। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড কর ছেঁকে নিলেই পেয়ে যাবেন নারকেল দুধ।
নারকেল দুধের কিছু উপকারিতা ঃ বাইরে থেকে এসে রোদে পোড়া জায়গায় নারকেল দুধ মালিশ করতে থাকলে ত্বকের পোড়া দাগ দূর হয় এবং উজ্জ¦লতা ফিরে আসে। নারকেল দুধ ত্বকের উপরে ব্যবহার খুব ভালো ময়েশ্চারইজার হিসাবে কাজ করে। চুলের পুষ্টি হিসেবে মাথায় ত্বকে ব্যবহারে চুলের বৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলে।
ত্বক ও চুলের পরিচর্চায় কার্যকারী কিছু প্যাক ঃ
১। শরীরের ত্বক মসৃণ ও কোমল করতে ঃ প্রথমে ঝুনা নারকেল পিষে দুধ বের করে নিন। আধা কাপ নারকেল দুধ ও ১ টেবিল চামক কফির সঙ্গে বড় দানার দেশি চিনি ভালো ভাবে পেষ্ট করে নিন। এরপর পুরো শরীরে ঘষুন। যতক্ষণ না চিনি গলে যাচ্ছে, ততক্ষণ হালকা হাতে ঘষতে থাকুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্ততঃ ২-৩ দিন নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকের মরা কোষ ঝরে গিয়ে ত্বক মসৃণ ও কোমল হবে।
২। ব্রণের সমস্যায় ঃ যাদের ত্বকে শুষ্ক ব্রণের সমস্যা আছে, তাদের জন্য- আধা কাপ নারকেল দুধে ১ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি ও ১০টি লবঙ্গ একসঙ্গে ভিজিয়ে রাখুন ৩০মিনিট। এরপর মিশ্রণটি পেষ্ট্ করে মুখে লাগান । ৩০ মিনিট পর কুসুম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৩। খুশকিও চুল পড়া দূর করতে ঃ ২কাপ নারকেল দুধ, ২টেবিল চামচ মেথি, ২ টেবিল চামচ মৌরি সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে মিশ্রণটি ভালো করে পেষ্ট করে মাথায়, ত্বকে ও পুরো চুলে লাগান। এক ঘন্টা পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন ব্যবহারে খুশকি দূর হবে এবং চুলপড়া বন্ধ হবে।
৪। সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে ঃ
ক) ২ টেবিল চামচ নারকেল দুধের সাথে গলানোর জন্য যতটুকু মুলতানি মাটি দরকার, ততটুকু নিয়ে একসঙ্গে মেশন। এরপর একটি ব্রাশ দিয়ে মুখে ও পুরো শরীরে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত রেখে হালকা মালিশ করে তুলে ফেলুন। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
খ) নারকেল দুধ কাঠবাদাম বাটা ও পরিমাণ মতো ময়দা একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি ২০ মিনিট ঢেকে রাখুন। এবার একটি ব্রাশ দিয়ে মুখে ও পুরো শরীরে লাগিয়ে নিন। শুকিয়ে যাওয়ার পর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
৫। চুলের কন্ডিশনার হিসেবে ঃ ২ চামচ মেথি বাটা ও ২ চামচ নারকেল দুধ মিশিয়ে পেষ্ট করে নিন। এরার যতœ করে চুলে লাগালেই ডিপ কন্ডিশনার হিসেবে অনেক ভালো কাজ করবে এবং চুলের গোড়ার কিউটিকল ভালো রাখবে।
৬। হেয়ার স্পা ক্রিম হিসেবে ঃ ১ কাপ নারকেল দুধ, ২ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে সাড়া রাত ফ্রিজে রেখে দিন। আধা ঘন্টা আগে ফ্রিজ থেকে বের করে কিছুক্ষণ রেখে এরপর চুলে ভালো করে লাগান। এক ঘন্টা রেখে তুলে ফেলুন। এই প্যাক হেয়ার স্পা ক্রিমের কাজ করবে।
৭। চুল সুন্দর ও নতুন চুল গজাতে ঃ আধা কাপ নারকেল দুধ, ১ টেবিল চামচ আমলকী পাউডার, ১ টেবিল চামচ হরীতকী পাউডার, ১টি ডিম ও আধা কাপ টক দই মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করুণ। মিশ্রণটি মাথার পুরো চুলে লাগিয়ে এক ঘন্টা পর পানি দিয়ে ধুয়ে এরপর শ্যাম্পু করুণ। এই প্যাক চুলের ডিপ কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করবে। রুক্ষতা কমাবে, চুলের গোড়া মজবুত করবে এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
৮। পাতলা চুলে ফোলাভাব আনতে ঃ ১ কাপ নারকেল দুধে ২ টেবিল চামচ মেথির গুঁড়া ভিজিয়ে রাখুন। এরপর পেক্ট করে চুলে লাগান। এক ঘন্টা পর ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাক আপনার পাতলা চুলে ফোলা ভাব আনবে।