জেনে নিন লাভজনক গোলমরিচ চাষাবাদের কলাকৌশল

লাভজনক গোলমরিচ

 

black-pepper
কৃষিবিদ মোঃ সিরাজুল ইসলাম

গোলমরিচ বা Black Papper সারা বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসলা। এটি তীব্্র ঝাল ও ঝাঁঝাল স্বাদের মসলা। এ কারণে তরকারিতে অল্প পরিমাণে ব্যবহার করলেই এর স্বাদ পাওয়া যায়। গোলমরিচে ঝাঁঝ তৈরির প্রধান উপাদান পাইপারিন। বেশি দামের কারণে প্রতিবেশি ভারতে এ মসলাকে ‘কালো সোনা’ বলা হয়। ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম গোলমরিচের প্রধান উৎপাদনকারী দেশ। সম্প্রতি ভিয়েতনামে প্রচুর গোলমরিচের চাষ হচ্ছে।
গুরুত্ব অনুযায়ী গোলমরিচকে ‘মসলার রাজা’ বলা হয়। গোলমরিচ গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- দেখতে পান গাছের মতো এবং পাতাও পান পাতার মতো। গাছের পাতা থেকে আকর্ষী বের হয়ে অবলম্বন গাছকে জড়িয়ে বাড়তে থাকে। গোলমরিচের গাছ বহুবর্ষজীবী, লতা ৪ মিটার লম্বা ও বেশ শক্ত হয়। পত্র কক্ষ থেকে ৪-৮ সে.মি. লম্বা মঞ্জুরীতে অনেকগুলো ফুল ফোটে। ফল প্রথমে সবুজ ও পরে হলুদ এবং পেকে গেলে লাল রঙ ধারণ করে। শীতকালে গোলমরিচের ফল পাকে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গোলমরিচ উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের সিলেট মৌলভিবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রামগড়, কাপ্তাই ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গোল মরিচ হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু গোলমরিচ চাষের জন্য উপযোক্ত। ২৫-৩০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এর চাষ ভাল হয়। পাহাড়ে ঢাল ইবং টিলার অনাবাদী জমি যেখানে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না এমন জমিতে গোলমরিচ ভাল জন্মে। অনেকে হয়ত মনে করতে পারেন যে,গোলমরিচের জন্য ছায়াযুক্ত স্থান আবশ্যক কিন্তু এটি একদম ঠিক নয়। আসলে উজ্জল সূর্যালোকে এর ফলন ভাল হয়। তবে গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদ এর জন্য ক্ষতি করতে পারে।গোলমরিচ চাষের মাটি খুব শুষ্ক এবং খুব ভিজাও নয়, এরূপ হলে ভাল হয়। মাটি অবশ্যই সুনিস্কাশিত হতে হবে। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হলে ভাল হয়। মাটির পিএইচ ৪-৬ অর্থাৎ অম্লধর্মী হলে ভাল হয়। ছায়াযুক্ত স্থান এর চাষের জন্য অবশ্যক নয়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০০০ মিটার উচুঁ পর্যন্ত জায়গায় গোলমরিচ জন্মানো যায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর, ভাওয়ালের গড়, গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া, নরসিংদীর বেলাবো ও রায়পুরা ইত্যাদি অঞ্চলের কাঁঠাল বা অন্যান্য বাগানে গোলমরিচ চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বাউনি হিসেবেও এসব গাছ ব্যবহার করা যাবে।

গোলমরিচের বংশবিস্তার ঃ বীজ (ঝববফ) ও কান্ডের কলম (ঈঁঃঃরহম) দিয়ে গোলমরিচের বংশ বিস্তার করা যায়। তবে চারা উৎপাদনের জন্য সচরাচর বীজ ব্যবহার হয় না। কারণ- বীজের গাছ বিলম্বে ফলন দেয়। এছাড়াও এতে মাতৃগুণাগুণ থাকে না। সুস্থ সবল ও উচ্চ ফলনশীল গাছ থেকে কলম নিয়ে বংশবিস্তার করা উচিত। ৫-২০ বছরের গাছ হতে কলম সংগ্রহ করতে হবে। কলমের জন্য ২০-৪০ সে.মি. লম্ব ৩টি গিটসহ লতা সংগ্রহ করতে হবে।
চারা রোপণ ঃ গুটি কলম, পলি ব্যাগের চারা বা বীজতলা হতে চারা উঠিয়ে মূল জমিতে রোপন করতে হবে। চারা রোপনের জন্য সবদিকে ৬০ সে.মি. মাপের গর্ত খুঁড়ে তাতে চারা লাগাতে হবে। সারি করে চারা লাগাতে হবে। সারি হতে সারি ও চারা হতে চারার দূরুত্ব ২ মিটার হতে হবে। চারার জন্য বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।

গোলমরিচের সার ব্যবস্থাপনা ঃ ভাল ফল আর বেশি ফলনের জন্য গোল মরিচ গাছে যথাযথভাবে সার দিতে হবে। চারা রোপনের পর প্রথম ৫ বছর পর্যন্ত সারের পরিমাণ কম লাগে। পরে সারের পরিমাণ বেশি লাগবে। ৫ বছর পর্যন্ত প্রতি গর্তে ১০ কেজি জৈব সার বা গোবর অথবা ২ কেজি সরিষার খৈল, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রতি বছর দিতে হবে। তবে সার সমান ২ ভাগে ভাগ করে এক ভাগ বর্ষার আগে এবং অন্য ভাগ বর্ষার পরে প্রয়োগ করতে হবে। চারার গোড়া থেকে কিছুটা দূরে গর্তের চর্তুদিকে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে। যখন গাছের বয়স ৫ বছরের বেশি হবে তখন একই পরিমাণ সার দিতে হবে বছরে ৪ বার। কিভাবে গোলমরিচ গাছে সার দিতে হবে তা নি¤েœর সারণির মাধ্যমে দেখানো হল ঃ

ক্র.নং সারের নাম
গর্তপ্রতি সারের পরিমাণ
প্রথম কিস্তি(জানুয়ারী) দ্বিতীয় কিস্তি(এপ্রিল) তৃতীয় কিস্তি(জুলাই) চতুর্থ কিস্তি (অক্টোবর)
০১. গোবর (কেজি) — ৫ — ৫
০২. টিএসপি (গ্রাম) — ২৫০ —
০৩. ইউরিয়া (গ্রাম) ১০০-১৫০ ১০০-১৫০ ১০০-১৫০ ১০০-১৫০
০৪. এমওপি (গ্রাম) ৫০ ৫০ ৫০ ৫০

গোলমরিচের আন্তঃ পরিচর্যা ঃ এজন্যে যা করতে হবে-
১. বাউনি দেয়া ঃ গোল মরিচ গাছ ১০ মিটার পর্যন্ত বাইতে পাবে। লতার গিট থেকে যে শিকড় বের হয় তা দ্বারা আঁকাড়ঁ ধরে আশ্রয়ী গাছ বেয়ে উপরে উঠে। পানের লতার মতো গোলমরিচের গাছও গ্রীষ্মের প্রখর রোদ সইতে পারে না বিধায় বাউনি গাছের ডালপালা থাকলে ভাল হয়। আম, কাঁঠাল, শিমুল ইত্যাদি গাছ বাউনি হিসেবে ভাল।
২. হরমোন স্প্রে ঃ গোলমরিচে অনেক সময় প্রচুর ফুল ধরলেও ফল ধরে না। উপরন্ত ফুল যায়। এক্ষেত্রে ‘প্লানোফিক্স’ নামক হরমোন স্প্রে করলে ভঅল ফল পাওয়া যায়।
৩. প্রুনিং বা গাছ ছাটাই ঃ গোলমরিচ গাছের প্রায়ই প্রচুর লতা গজিয়ে ঝোপ হয়ে যায়। ঝোপ অবস্থায় ফলন কম হয়। গাছের বয়স ৫ বছর হলে ৪-৫ টি ভাল লতা রেখে বাকীগুলো ছাটাই করতে হয়। তবে ৫ বছরের পূর্বে কোন ছাঁটাইয়ের দরকার নেই।
৪. মিশ্র চাষ ঃ গোলমরিচ চাষে যেহেতু বাউনি বা আশ্রয়দাতা গাছের প্রয়োজন হয় এজন্য গোলমরিচ গাছের সাথে অন্যান্য বড় গাছের মিশ্র চাষ করা যায়। যেমন- নারিকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল, শিমুল, কামরাঙা ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে, সুপারি গাছের সাথে গোলমরিচের চাষ আর্থিক ভাবে সবচেয়ে লাভবান হয়। এক্ষেত্রে গোলমরিচের পেনিয়ুর- ১ জাত চাষ করা ভালো।
৫. বালাই ব্যবস্থাপনা ঃ গোলমরিচ গাছে তেমন পোকা রোগের আক্রমণ দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে স্কেল পোকা, কান্ড ছিদ্রকারী পোকা, ডগা ছিদ্রকারী পোকা, ছাতরা পোকা, গল, থ্রিপস পোকা দেখা যায়। অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করে, এসব পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

গোলমরিচ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ঃ এজন্যে যা করতে হবে-
১. ফসল সংগ্রহ ঃ গোলমরিচের চারা রোপনের পর ফল ধরতে প্রায় ৪-৫ বছর সময় প্রয়োজন হয়। পূর্ণ ফলন আসে ১০ বছর বয়সে এবং যতœ নিলে ২০ বছর পর্যন্ত একই গাছ থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায়। গোলমরিচের গাছে ফুল আসে এপ্রিল-জুন মাসে, ফল পাকে ডিসেম্বর মাসে। লম্বা ছড়ায় গোল গোল ছোট ফলগুলো যখন ক্রমে লাল হতে শুরু করে তখনই ফল সংগ্রহ করতে হয়। বেশি পাকলে ফল ঝরে যাবে।
২. ফল প্রক্রিয়া করণ ঃ গাছ থেকে পাকা ফলের ছড়া ধারালো কাঁচি দিয়ে কেটে গাছের ছায়ায় ছাটাইর উপর জমা করতে হবে। এরপর ছড়া থেকে পাকা ফলগুলো আলাদা করতে হবে। আলাদাকৃত ফল পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এবার ফুটন্ত পানিতে ১০ মিনিট সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধকৃত ফল পানি থেকে তুলে পানি ঝরিয়ে রোদে শুকাতে হবে। শুকানো ফলের খোসা কুচকে কালো রং ধারণ করবে। এছাড়া সিদ্ধ করা পানি সংগৃহীত গোল মরিচের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে, তাতে মরিচের রং, গন্ধ ভাল হয় এবং ঝাল কমবে না। ৬-৭ দিন কড়া রোদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে বাজারজাত করা যাবে।
উল্লেখ্য যে, পূর্ণ বয়স্ক গাছে প্রতি বছর ৪-৫ কেজি টাটকা ফল পাওয়া যায়। যা থেকে ১.৫ কেজি শুকনা গোল মরিচ পাওয়া যাবে। ২.৫ মিটার দূরত্বে গোল মরিচ গাছ লাগালে হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয় ২০০০-৩০০০ কেজি। ১০০ কেজি কাঁচা ফল থেকে ৩৩ কেজি শুকনো কালো গোল মরিচ ও শুকনো ২৭ কেজি সাদা গোল মরিচ পাওয়া যায়।

গোলমরিচের ব্যবহার ঃ গোল মরিচ পাঁচফোড়নের প্রধান মসলা। রান্নাকে সুস্বাদু করাই এর প্রধান কাজ। মাংস রান্নাতে এর ব্যবহার সব চেয়ে বেশি। বিভিন্ন রকম ব্যঞ্জন, বিভিন্ন প্রকার আচার, চটপটি ও চাটনি রান্নায় এর ব্যবহার হয়। গোলমরিচের গোঁড়া মসলা হিসেবে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের সাথে ব্যবহার হয়। দ্রুত পচনশীল খাদ্য সংরক্ষণে এর ব্যবহার হয়। টিনজাত বা ক্যানে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো ব্যবহার করে খাদ্যকে অনেকদিন ভাল রাখা যায়।

গোল মরিচের প্রধান উপকরণ বিভিন্ন এ্যালকালয়েড, যার মধ্যে ‘পাইপারিন’ অন্যতম যা গোলমরিচের ঝাঁঝ আনায়ন করে। এর ভেষজগুণ অনেক। সর্দি, কাশি, কফ, বুকের ব্যাথ্যা, উদরাময়, ম্যালেরিয়া, কলেরা, জ্বর, অর্শ, গ্যাষ্ট্রিক, অ্যাজমা, চর্মরোগ, দাঁত ব্যাথ্যা, গোনরিয়া, মূত্রাবরোধ, ফিক ব্যাথা, ক্রিমি, অর্শ ইত্যাদি বহুবিধ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *