কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ
দক্ষিণ-পূব এশিয়ার ফলসমুহের মধ্যে লিচু অন্যতম। লিচু সাধারনত উষ্ণ ও অবউষ্ণম-লীয় অঞ্চলের স্বার্থকভাবে জন্মে। চীনের দক্ষিণ অঞ্চলে লিচুর উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয় তবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহামহাদেশে লিচু সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল কারন এ ফল বৈচিএ্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান ও স্বাদে-গন্বেধ অতুলনীয়। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলে লিচু জন্মে কিন— দেশের উরাঞ্চলে (বিশেষ করে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজ পুর, রং পুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর প্রভৃতি অঞ্চলে) এর বানিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। লিচু চাষীরা প্রতি বছর অনেক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন সাধারনত দুই প্রকারের সমস্যার কারনে যথা ঃ (অ) প্রাকৃতিক কারন (যেমন- ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি) এবং (আ) রোগ ও (ই) পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্চা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষতি প্রায় স¤পূর্ণ রুপে সমাধান করা সম্ভব। নীচে ইহা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল ঃ-
ফল না ধরা ও ঝরে পড়ার কারণসমুহ ঃ
(১) লিচু গাছে সাধারনত এক বছর বেশী ধরে এবং পরের বছর কম ধরে ( একে অল্টারনেট বিয়ারিং বলে)। (২) কৌলিক গঠন, (৩) গর্ভমুন্ডে নিম্ন পরাহহীনতা, (৪) বর্ধিত ভ্রণের পুষ্টিহীনতা, (৫) একই ছড়ায় অনেক গুলি ফল ধারন, (৬) সুষম পুষ্টির অভাব, (৭) প্রবল ঝড়, (৮) শিলাবৃষ্টি, (৯) দীঘ সময় খরা, (১০) মাটিতে রসের অভাব, (১১) হরমোনের অসাম্যতা, (১২) রোগ ও (১৩) পোকা-মাকড়ের অক্রমণ ইত্যাদি।
(অ) ফলন্ত লিচু গাছের যত্ন পরিচর্যা ও ফল ঝরা রোধ করণিয় ঃ
(১) সুষম সারের ব্যবহার করতে হবে। একটি ৫- ১০ বছরের লিচু গাছে জৈব সার ২৫-৪০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টি.এস.পি ৫০০ গ্রাম, এম.পি ২৫০ গ্রাম মিশ্রণ করে তিন ভাগে ভাগ করে প্রতি বছর তিন বার প্রয়োগ করতে হবে ( ফেব্রুয়ারী, মে ও আগষ্ট মাসে )। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কোপায়ে আলগা করে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে যদি জিংকের অভাব দেখা যায়, অথাৎ পাতা যদি তামাটে রং ধারন করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার পানিতে ২ কেজি জলান্বিত চুন ও ৪ কেজি জিংক সালফেট গুলিয়ে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। তবে উপরে উল্লিখিত সারগুলি গাছের বয়স ৫ বছরের নীচে হলে উহার অর্ধেক এবং গাছের বয়স ১০ বছরের বেশী হলে উহার দেড়গুণ সার প্রয়োগ করতে হবে। (২) খরা মৌসুমে গাছে সেচ দিতে হবে। মাটির ধরন অনুসারে খরার সময় ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। (৩) লিচুর বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। লিচুর শিকড় গভীর ভাবে আমের মত মাটির নীচে প্রবেশ করে না তাই বছরে ৩-৪ বার অগভীর ভাবে চাষ দিলে ভাল হয়। (৪) গাছের গোড়ায় গরু-মহিষ বাঁধানো বা মানুষ চলাচলের পথ রাখা যাবে না। (৫) ফল খুব ছোট থাকা অবস্থায় প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে ১ মিলি প্লানোফিক্্র এক/ দুই বার স্প্রে করলে ফল ঝরা বন্দ্ব হয়। (৬) জিংক সালফেট দ্রবণের সাথে ২,৪-ডি (১৫ পিপিএম) স্প্রে করে ফল ঝরা কমানো যায়।
(আ) পোকা দমন ঃ
লিচুর মাইটস ঃ
ইহা লিচুর জন্য সব চেয়ে ক্ষতিকারক মাকড় এর কারনে লিচুর ফলন শুন্যে কাছাকাছি আসতে পারে।
লক্ষণসমুহ ঃ (ক) অতি ক্ষুদ্র সাদা রং এর মাইট পাতার পিছনে বাদামি ভেলভেট তৈরী করে বসবাস করে।
(খ) এতে পাতা পুরু হয়, দুমড়িয়ে থাকে এবং মারা যায়।
(গ) এরা পাতা নীচের দিকে ভক্ষণ করে।
(ঘ) সাধারণত মার্চ- জুলাই মাসে এদের আক্রমন বেশী দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থা ঃ (১) সালফার (গন্দ্বক) চুর্ণ প্রয়োগ করে এ মাকড় দমন করা যায়। (২) গাছে নুতন পাতা বের হওয়ার সাথে সাথে কেলথেইন ০.১২ % হারে তিন সপ্তাহ পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে অথবা ডাইমেথোয়েট ০.০৫ % হারে ব্যবহার করা যেতে পারে। (৩) মেটাসিস্টক্্র ০.২ % হারে ব্যবহার করেও উকার পাওয়া যায়।
বাকল খেকো পোকা ঃ
লক্ষণসমুহ ঃ (ক) মে-জুন মাসে পূর্ণ বয়স্ক প্রজাপতি গাছের বাকলে ডিম পাড়ে। (খ) ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং এগুলি বাকল ভক্ষণ করে, পরে কা- ছিদ্র করে। (গ) আক্রান্ত ডাল দুর্বল হয় এবং ফল ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা ঃ (১) বাগান পরিস্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। (২) ডালের ছিদ্র দিয়ে পেট্টোল ঢেলে বা ফরমালিন ঢেলে এবং পরে মাটি বা মোম দিয়ে গর্তের মুখ বন্দ্ব করে দিতে হবে।
লিচুর বীজ ছিদ্রকারী পোকা ঃূ
ক্ষতির প্রকৃতি ঃ(ক) এ পোকার ক্ষুদ্র কীট ফলের বোটার প্রান্ত দিয়ে বীজের মধ্যে প্রবেশ করে। (খ) এর আক্রমনের ফলে এক ধরনের বাদামী গুড়া ( পিপিলিকার মাটির মত) দেখতে পাওয়া যায়। (ঘ) পাকা ফল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয় এবং বাজার মুল্য কমে যায়। (ঘ) ফল পাকার সময় মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টিপাত হলে এ পোকার আক্রমন বেশী হয়।
দমন ব্যবস্থা ঃ (১) ফল সংগ্র করার পর অবশিটাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (২) বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং ঝোপ-ঝাড় রাখা যাবে না। (৩) এ পোকার আক্রমন হয়ে গেলে ডাইমেক্রম ১ মিলি প্রতি লিটার ( ১ লিটার পানিতে) মিশে অথবা ম্যালাথিয়ন ০.১ % হারে পানিতে মিশে ফল পুষ্ট হবার ১৫ দিন পূবে স্প্রে করতে হবে।
বাদুড় দমন ঃ
পোকা-মাকড় ছাড়াও লিচুর অন্যতম আপদ হল বাদুড়। প্রতি বছর এদের আক্রমনে প্রচুর পরিমান ফল নষ্ট হয়। এরা ফল পাকা শুরু হলে সাধারনত রাতে ডালে ডালে ঝুলে পাকা ফল খেতে থাকে। বর্তমানে বাদুড়ের মাধ্যমে অনেক প্রকার রোগ ছড়িয়ে পড়তেছে, যেমন- নিপা ভাইরাস। তাই বাদুড় তাড়িয়ে ফল রক্ষা ও রোগ থেকে মুক্তি ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন।
দমন ব্যবস্থা ঃ লিচু পাকার সময় ফল রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রচলিত ও সহজ উপায়সমুহ হল ঃ (১) ঢোল ও টিন পিটানো, (২) ফাঁটা বাঁশ ফোটানো, (৩) পটকা ফোটানো, (৪) বাগানের চার পার্শ্বে জা পেতে, (৫) জাল দিয়ে ফল গাছ ঢেকে রেখে ইত্যাদি।
(ই) রোগ দমন ঃ
ফল পচা বা ফ্রট রট ঃ এ রোগ এক প্রকার ছএাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণসমুহ ঃ (ক) প্রথমে ফলের উপর ছিটা ছিটা দাগ পড়ে। (খ) উক্ত দাগ একএ হয়ে বঢ় আকার ধারন করে এবং কালো বর্ণ ধারন করে। (গ) ফল শুকিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থাঃ (১) শুকনো ডালপালা বা অবশিটাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (২) ফলে বোর্দোমিক্্রার ও ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগ করতে হবে।
(ঈ) পোকামাকড় দমন ঃ
আমের শোষক পোকা/ আমের হপার (Mango hopper)
এই পোকার তিনটি প্রজাতি ক্ষতি করে থাকে। নিন্নে ক্ষতির প্রকৃতি ও দমন ব্যবস্থা দেয়া হল।
ক্ষতির প্রকৃতি ঃআমের অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে এ পোকা সব চেয়ে বেশী ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমের পাতা ও বোটায় এরা ডিম পাড়ে। এজন্য আক্রান্ত পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং গুটি আসার পূর্বেই ফুল ঝরে য়ায়। এতে ফলন মারাত্থকভাবে কমে যায়। এ পোকার আক্রমনের অন্যতম লক্ষণ হল, আক্রান্ত গাছের নীচে দিয়ে হাঁটলে পোকা লাফিয়ে গায়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা ঃ এ পোকা দমন করতে হলে মুকুল আসার আগে অথবা মুকুল আসার মুহুর্ত থেকে নিম্নলিখিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে ঃ ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লেবাসিড ৫০ ইসি চা চামুচের ৪ চামুচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দুই বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ম্যালাথিয়ন বা এম.এস.টি ৫৭ ইসি উপরোক্ত মাএায় স্প্রে করতে হবে।
ফলের মাছি বা আমের মাছি পোকা (Mango fruit fly)
ক্ষতির প্রকৃতি ঃ এ পোকার কীড়া পাকা আমের মধ্যে প্রবেশ করে শাঁস খেয়ে ফেলে। এতে ফল পচে যায় ও ঝরে পড়ে। আক্রান্তআম কাটলে অসংখ্য পোকা দেখা য়ায়। পোকার আক্রমন বেশী হলে গাছের সমস্ত আম খাওয়ার অনুউপযোগী হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা ঃ আম পাকার পূর্বে যখন পূর্ন বৃদ্বিপ্রাপ্ত হয় ডিপটেরেক্্র চা চামুচের ৪ চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর দুই বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ২মিলি/লিটার পানিতে মিশে ফলে স্প্রে করতে হবে ( উক্ত সময়ে ফল খাওয়া যাবে না)।
আমের বিছা পোকা (Mango defoliator)
ক্ষতির প্রকৃতি ঃ এ পোকার কীড়া আম গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। আক্রমনের মাএা বেশী হলে গাছ পএ শূন্য হয়ে যায় এবং ফুল-ফল হয় না বা হলেও ঝরে পড়ে। তবে কোন গাছ একবার আক্রান্ত হলে বার বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভনা থাকে।
দমন ব্যবস্থা ঃ আক্রান্ত গাছে ডাইমেক্রম ১০০ ইসি ৩০০ মিলি বা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ৪০০ মিলি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ৪৫৪ মিলি ২২৫ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করতে হবে।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ
চায়না ৩ লিচু আমার ঝরা ও ফাটা সমস্যা সমস্যা আমার কি ভাবে প্রতিকার পাবো?
আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। লিচু গাছে মুকুল আসার আগে প্রতি গাছের গোড়ায় ৫০ গ্রাম বোরন সার বা সলুবর এবং ১০০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট হেপ্টা সার জমি কুপিয়ে দিতে হবে। এরপর পানি সেচ দিতে হবে। মাটিতে যেন রস পর্যাপ্ত থাকে সেজন্য খড় কুটা দিয়ে জাবড়া দিতে হবে।
আমাদের একটি ১৫-১৬ বছর বয়সি লিচু গাছ আাছে। ৫-৬ বছর আগে অল্প পরিমাণ মুকুল আসলেও এখন একটিও মুকুল আাসে না। এমতাবস্তায় করণীয় কি? জানালে খুবই উপকৃত হব।
আমাদের একটি ৬ _৭বছর বয়সি লিচু গাছ আাছে। ৪ বছর আগে অল্প পরিমাণ মুকুল ও অল্প ফল হয়েছিল ,এখন কোন মুকুল আাসে না।মাটির প্রকৃতি বেলে দোআশ ।২০এপ্রিল২০২০তারিখে ২৫কেজি শুকনো গোবর / জৈব দিয়েছি, এমতাবস্তায় করণীয় কি? জানালে খুবই উপকৃত হব।