সামছুল আলম, শেকৃবি থেকে
সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে একদিকে যেমন বাড়ছে জনসংখ্যা অন্যদিকে কমে যাচ্ছে আবাদি জমিও। আর বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে অল্প আবাদি জমিতে চাষীরা অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করছে নানা ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক পদার্থ। আর এসব রাসায়নিক পদার্থ থেকে নিঃসৃত নানা ধরনের কারসিনোজেনিক পদার্থ যা খাদ্য ,পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে প্রবেশ করছে আমাদের শরীরে। ফলে মানুষের শরীরে বাসা বাধছে প্রাণঘাতী ব্যধি ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগ। এছাড়া বর্তমানে নানা ধরনের মোহরুচক ফাস্টফুড খেয়েও মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিক ও রক্তনালী সংক্রান্ত নানা ধরনের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রাণঘাতী এসব রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে(শেকৃবি) গবেষণার মাধ্যমে চাষ করা হয়েছে এক ধরনের নতুন সবজি রুকলা। যা নানা উপায়ে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিরোধ করা যাবে এসব প্রাণঘাতী রোগ। দীর্ঘ আড়াই বছর গবেষণা করে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত চাষ করা হয় এ উদ্ভিদ। আর নিয়ে গবেষণা করেন শেকৃবির কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.মো.আব্দুর রহিম।
জানা যায়, রুকোলা সরিষা পরিবারের(ব্রাসিকাসিয়া) একটি বর্ষজীবী নরম কান্ড ও সবুজ পাতা বিশিষ্ট এক ধরনের উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঊৎঁপধ ংঃরাধ. এর উৎপত্তিস্থল ভ’মধ্যসাগরীয় অঞ্চল। এটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে চাষ করা হচ্ছে। ইটালিতে এটি রুকোলা নামে রোমান কাল থেকে চাষ করা হচ্ছে বলে ধারনা করা হয় এর আদি নিবাস ইটালিতে। এছাড়াও এটি আমেরিকাতে আরগুলা , জার্মানীতে সালাট্রুকা, স্পেনে ইরুকা এবং ফ্রান্সে রকেট নামে চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া এটি শীতকালীন একটি সবজি। শীতকালে পাতার বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। বপনের এক মাস পর থেকে পাতা সংগ্রহ করা যায়। বসন্তকালে গরম আবহাওয়ায় ফলের স্টক তৈরি করে এবং বীজ ধারণ করে। এটি সরিষার পডের মত পড তৈরি করে বীজ ধারণ করে। এটি ২০ থেকে ১০০ সেমি পর্যন্ত উচু হয়ে থাকে। এর পাতা রসালো, লম্বাটে ও খাঁজযুক্ত। বীজের মাধ্যমেই এর বংশ বিস্তার করা হয়।
রোগপ্রতিরোধী গুণাগুণ: মূলত রুকোলার সবুজ পাতায় রয়েছে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ফ্লাভোনল নামক অ্যান্টিঅক্্িরডেন্ট যা ত্বক, ফুসফুস, এবং মুখ গহবর ক্যান্সারের বিরোদ্ধে কাজ করে। এছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসহায়ক রাসায়নিক উপাদান সালফিউরান(যা হিস্টোন ডিঅ্যাসিটাইলেজ নামক এনজাইমের কার্যকারীতা ব্যহত করে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি রহিত করে),থায়োসায়ানেটস,আইসোসায়ান্টেস, ইনডলস এবং আলফা লিপোইক এসিড যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন প্রোস্টেট, ব্রেস্ট ,সারভিক্যাল, কোলন এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের বিরোদ্ধে কাজ করে। তাছাড়া রুকোলার পাতা তেলে ভাজলে বা ঝলসালে এর মধ্যে থাকা ক্লোরোফিল ও হেটারোসাইক্লিক অ্যামাইন নিঃসৃত হয় যা দেহকে কার্সিনোজেনিক প্রভাব থেকে রক্ষা করে প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে রুকোলাতে আলফা লিপোইক এসিড বিদ্যমান থাকে যা রক্তে গ্লোকোজের মাত্রা কমিয়ে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে ডায়াবেটিক রোগও নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া গবেষণায় আরো পাওয়া যায় রুকোলা পাতা নিয়মিত খেলে হৃদপিন্ড ও রক্তনালী রোগের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি একশ গ্রাম রুকোলাতে রয়েছে স্বাস্থ্যসহায়ক ২৫ কিলোক্যালরি শক্তি,৯৭ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড, ভিটামিন এ (২৩৭৩ আইইউ),ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ১০৮.৬ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন বি কমপ্লক্্র।
নতুন সবজি রুকোলা নিয়ে গবেষক ড. আব্দুর রহিম বলেন, রোগ প্রতিরোধী এ সবজিটি আমাদের দেশে সারা বছর চাষ করা যাবে। এটি সালাদ হিসেবে টমেটো ,জলপাই ও পনীরের সাথে , পিজা তৈরির পর পরিবেশনের সময় পিজা টপিং হিসেবে, পাস্তার সাথে এবং মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের সাথে ব্যপকভাবে সমাদৃত। এছাড়া এর বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদন করা যায়। তাছাড়াও একে সরাসরি সবজি হিসেবে পালংশাকের মত রান্না করে খাওয়া যায়। এর উৎপাদন সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যপোকারী এ রুকোলার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু এটি সারা বছর উৎপাদন করা সম্ভব তাই একে বাড়ির আঙ্গিনায়,শহরের বাড়ির টবে,ছাদে কিংবা বেলকুনিতে জন্মিয়ে সারা বছর সতেজ পাতা পাওয়া সম্ভব। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে দেশের বড় বড় রেস্টোরেন্ট এবং ফাস্টফুডের স্টল গুলোতে বিক্রি করা যাবে । পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।#