কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
চা চাষ শুরু সম্ভাবনার নতুন ডানা
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তার মাধ্যমে চা চাষে যুক্ত হয়েছে ভারত সীমান্তবর্তী শেরপুরের পাহাড়ি অঞ্চল। ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তী পাহাড়ী জনপদে প্রথমবারের মতো চা চাষ শুরু হয়েছে। ‘গারো হিলস টি কোম্পানী’ নামে নব প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকজনকে উদ্ধুদ্ধকরণ ও তাদের সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে এ চা চাষ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতির চা বাগানের জন্য স্থানীয় ২৭ জন কৃষকের মাঝে ২৭ হাজার উন্নত জাতের ‘টেটলি টি’ চা চারা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনপদে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
গারো হিলস টি কোম্পানীর চেয়ারম্যান আমজাদ হোসাইন ফনিক্স বলেন, ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ে ২৭ জন ক্ষুদ্র চাষীর মাধ্যমে ২৭ টি প্রদর্শনীতে যে চা চাষ কার্যক্রম শুরু হলো, তা গারো পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়বে। আর এর মাধ্যমে পাহাড়ি জনপদে দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি উৎপাদিত চা শেরপুর জেলা তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, সরকার যদি পুরো সহযোগিতা করেন তবে এ পাহাড়ে চা আবাদ করে বিপ্লব ঘটানো যাবে। সম্প্রতি ঝিনাইগাতীর বনরানী রিসোর্টে চাষীদের মাঝে চা গাছের চারা বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তিনি একথা বলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি বিশেষজ্ঞ দল শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জমির মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে। সে সময় তারা ঝিনাইগাতী উপজেলায় এক হাজার ৮৫৬ একর, নালিতাবাড়ী উপজেলায় দুই হাজার ৫০০ একর ও শ্রীবরদী উপজেলায় এক হাজার ১৫১ একর জমি রয়েছে যাতে চা চাষ করা সম্ভব বলে মতামত দেয়। কিন্ত প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উদ্যোক্তা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা গড়ে উঠেনি। প্রায় ১৪ বছর পর এবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গারো হিলস টি কোম্পানীর উদ্যোগে চা চাষ শুরু করা হয়েছে। আর এ চা চাষের মাধ্যমে এ অঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। চা চাষের মাধ্যমে পাহাড়ি জনপদে বন্যহাতির তান্ডব কমবে এবং এ অঞ্চলে পর্যটনের বিকাশ ঘটবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
চা চাষী মো. আব্দুল মোত্তালেব বলেন, ‘এ চা চাষটা আমগর গারো পাহাড়ে আরও অনেক বছর আগে থেকে আসবো আসবো করে শুনতাছি। গত বৈশাখ মাসে ফনিক্স সাহেব (কোম্পানির চেয়ারম্যান) আইসে আমগর পঞ্চগড় নিয়ে গেছিল। ওইখানে গিয়ে টেকনাফ, তেঁতুলিয়া, জিরো পয়েন্ট বেড়াইয়ে দেখলাম চা চাষ করে ওই দেশটা (পঞ্চগড়) খুব উন্নত হয়ছে। আর আমরা যে ফসলগুলা আবাদ করি তা হাতি খাইয়ে যা গা। এতে আমরা লাভবান হয় না। শুনছি চা গাছটা হাতি খায় না। তাই আমরা এবার চা চাষ করে অনেক লাভবান হব।’ গারো নেতা অরুন ম্রং বলেন, ‘গারো পাহাড়ে বন্যহাতির আক্রমণে ফসলাদি যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত। আর এজন্য এ এলাকার চাষী ভাইয়েরা ফসল ঘরে তুলতে পারে না। যেহেতু এ এলাকা চা চাষে উপযোগী তাই চা চাষ করতে চাষীরা ব্যাপক আগ্রহী হয়েছে।’
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে’র (বিটিআরআই) সাবেক সহকারী অধ্যক্ষ এমএ খালেক জানান, ‘শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চা চাষাবাদের জন্য জমির মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার সময় আমি বিশেষজ্ঞ দলের সাথে ছিলাম। এখানকার মাটি, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও অন্যান্য পরিবেশগত অবস্থা চা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।’ গারো হিলস টি কোম্পানীর উদ্যোক্তা আমজাদ হোসাইন ফনিক্স জানান, পঞ্চগড়ের সমতল ভুমিতে চা চাষের অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগানো হবে। ইতোমধ্যে কয়েকদফা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে ক্রস ভিজিট করা হয়েছে। তিনি বলেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা, নেত্রকোনার দূর্গাপুর, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এবং জামালপুরের বকমীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি জনপদের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া চা চাষাবাদের অত্যন্ত উপযোগি। দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন সময় শেরপুরের পাহাড়ি টিলায় বাংলাদেশ টি বোর্ড চা চাষাবাদের উদ্দেশ্যে মাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চা চাষাবাদের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্ত উদ্যোগের অভাবে অদ্যাবধি তা গড়ে উঠেনি। গারো পাহাড়ের পাদদেশে তাওয়াকোচা, গুরুচরন দুধনই, পানবর, বাকাকুড়া, ছোটগজনী, গান্ধিগাঁও, হালচাটি, গজনী, নওকুচি, রাংটিয়া, ডেফলাই, সন্ধ্যাকুড়া, গোমড়া ও হলদিগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক পতিত জমি রয়েছে। এতে চা চাষ করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রচুর মুনাফা অর্জন সম্ভব। তাই স্থানীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গারো পাহাড় অঞ্চলে চা চাষের সূচনা করা হয়েছে। আশাকরি অচিরেই এর সুফল মিলবে।
পঞ্চগড়ের সবুজ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং পার্টনার শাহিরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি নিজে একজন চা চাষী। যে এলাকায় ‘টহরুই’, ‘কালোগোটা‘, ‘কালো নেওয়া’ অর্থ্যাৎ ‘নিশি বৃক্ষ’ গাছ জ্নমে। ওই এলাকা চা চাষের জন্য উপযোগী। এখানে এসে এ গাছগুলো প্রচুর দেখতে পেলাম। তাই এ এলাকায় প্রচুর চা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। চা চাষীদের সাথে উদ্যোক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।’ ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. রাশেদুল হাসান বলেন, ‘একসময় চা চাষ সিলেটেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০০০ সালে সালে পঞ্চগড়ে ও ২০০৫ সালে চট্টগামে চা চাষ শুরু হয়। এখানেও দীর্ঘদিন গবেষণা ও চেষ্টা করা হচ্ছিল চা চাষের জন্য। আমরা যদি মাটির দিক থেকে চিন্তা করি এখানকার মাটি সিলেট-পঞ্চগড়ের মাটি মোটামুটি একই রকম। সুতরাং এখানে চা চাষ উপযোগী। বেসরকারী উদ্যোগে যে চা চাষ শুরু হয়েছে তা সাধুবাদ জানাই। এখানে চা বাগান গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পর্যটনেও আকৃষ্ট হবে। চা চাষে যে কান ধরনের সহযোগিতা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনের ভেতরে থেকে করা হবে।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা বলেন, বহু আগে থেকেই গারো পাহাড়ের পাদদেশের এ অঞ্চলে চা চাষের দাবি উঠে আসছিলো। চা গবেষকরা মনে করেন সরকারি কিংবা বেসকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এখানে চা চাষাবাদ করে প্রচুর পরিমাণে অর্থ আয় ও গারো পাহাড়ের শতশত বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু এতদিন সরকারি-বেসরকারিভাবে এর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। পাহাড়ি জনপদে কর্মসংস্থানের খুব অভাব এমন অবস্থায় এগিয়ে এসেছে গারো হিল্স টি কোম্পানী। আমরা তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। আশাকরি এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনপদে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
…
লেখকঃমফস্বল সম্পাদক,কালের কণ্ঠ,বসুন্ধরা, ঢাকা।