সবুজ কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে ঝুঁকছেন কৃষক: নকলায় আলোক ফাঁদে বিষমুক্ত ফসল

আলোক ফাঁদে বিষমুক্ত ফসল

 


মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) :

কৃষি প্রধান এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হলো কৃষি খাত। আর আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে পরিবেশবান্ধব এবং স্থায়ীত্বশীল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিষ মুক্ত ফসল উৎপাদনে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারে তা আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাইতো কৃষি বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নির্মল পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহিত করছে কৃষি বিভাগ। তার অংশ হিসেবে যেকোন ফসলের মাঠে অধিক কার্যকরী আলোক ফাঁদ প্রযুক্তিটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজস্ব খাত ও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আলোক ফাঁদ ব্যবহার দেশব্যাপী বৃদ্ধি করেছে। অল্প ব্যয়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে দিন দিন এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক জনের দেখা দেখি অন্য কৃষকরাও এটি ব্যবহারে ঝুঁকছেন এবং সবাই কম-বেশি লাভবান হচ্ছেন। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সফলতায় কৃষি খাতে উৎপাদন ও আয় পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। আর আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে শেরপুরের নকলা উপজেলায় অর্ধসহ¯্রাধিক কৃষি পরিবার পোকা দমনে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাদের চিন্তাধারা বদলে গেছে। আর তাইতো ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার ময়মনসিংহ অঞ্চলের ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর ও জামালপুর এই চারটি জেলায় একযোগে একহাজার ৮৪ টি ব্লকে আলোক ফাঁদ স্থাপন করে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে শেরপুর জেলাধীন ৫ টি উপজেলার আওতায় ১৬০ টি কৃষি ব্লকে কয়েক হাজার আলোক ফাঁদ স্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে নকলা উপজেলার ২৮টি ব্লকে ওই ফাঁদ স্থাপন করা হয়। উপারের দিক বিবেচনায় কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিদিন ওই আলোক ফাঁদ স্থাপন করে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি নির্ণয় করাহয়।

 

কৃষি অফিসের তথ্য মতে, নকলায় ৩২ হাজার ৪৫টি কৃষক পরিবার রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক কৃষি পরিবারকে সেবাদান নিশ্চিত করতে একটি পৌরসভা ও ৯ ইউনিয়নকে ২৮টি ব্লকে ভাগ করে ব্লকে প্রয়োজন মতো উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে কৃষি বিষয়ে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাতেকরে চলতি বছর প্রায় অর্ধসহ¯্রাধিক কৃষক তাদের সব আবাদে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া কৃষি উন্নয়ন ও উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে ১৫১টি কৃষি স্কুলের মাধ্যমে কৃষক-কৃষানিদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষনের অন্যতম আলোচ্য ও শিক্ষনিয় বিষয় হলো যেকোন মাঠ ফসলে পার্চি ও আলোক ফাঁদ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মোশারফ, সাধারণ সম্পাদক হেলাল, প্রতিষ্ঠাতা ছাইদুল হকসহ অনেক সদস্য জানান, ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে বালাই ব্যবস্থাপনা বা আলোক ফাঁদের সংখ্যা নির্ধারন করলে অধিক সুফল পাওয়া যায়। তাই জমিতে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে উপস্থিত ক্ষতিকর পোকার ধরন নির্ণয় করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে ফসলের ক্ষেত হতে ৫০ মিটার থেকে ২০০ মিটার দূরে আলোক ফাঁদ স্থাপন করা উত্তম। তবে এমন সুযোগ না থাকলে প্রয়োজনে আবাদী জমির ভিতরেও ফাঁদ স্থাপন করা যেতে পারে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জানান, সূর্যাস্তের আধা ঘন্টা পরে ২ হতে ৩ ঘন্টার মধ্যে আলোক ফাঁদ স্থাপন করে কমপক্ষে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা ফাঁদ পেতে রাখতে হয়। ফসলের ক্যানোপি বা উপরি অংশ হতে ২ বা ৩ ফুট উপরে ঝুলন্ত অবস্থায় আলোক ফাঁদ স্থাপন করতে হয়। আর আলোক উৎসের নিচে ডিটারজেন্ট ও কেরোসিন মিশ্রিত পানির বল বা গামলা রেখে দিতে হবে। তাতে করে আলো সংবেদনশীল বা আলোতে আকৃষ্ট হয় এমন ক্ষতিকর পোকা এসে ওই পানিতে পড়ে মারা যায়। এতে সংশ্লিষ্ট মাঠে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি জানা যায়। সে মতে কৃষকদের পরামর্শ সেবা দেয় কৃষি অফিস। এই প্রযুক্তিতে তেমন কোন ব্যয় না হলেও বেশ সুফল পাওয়া যায়। তবে এই প্রযুক্তিটি প্রতিদিনের শ্রম সাপেক্ষ। তবুও কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে আলোক ফাঁদের কোন কোন বিকল্প নেই। আর তাইতো কৃষি বিভাগ এই প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে বাড়াতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নির্মল পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে সবুজ কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে তারা কৃষকদের উৎসাহিত করছেন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, সবুজ কৃষি প্রযুক্তির অংশ হিসেবে আলোক ফাঁদের কোন বিকল্প নেই। আলোক ফাঁদ স্থাপনকরা তাদের রুটিন ওয়ার্ক। এই ওয়ার্কের অংশ হিসেবে চলতি মৌসুমে নকলার ২৮টি ব্লকে এ পর্যন্ত দেড়শতাধিক আলোক ফাঁদ ইতি মধ্যে স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। তারা অরো জানান, কৃষি অফিসের তত্বাবধানে স্থাপিত আলোক ফাঁদের সুফল দেখে অন্যান্য কৃষকরাও কমপক্ষে চার শতাধিক আলোক ফাঁদ স্থাপন করে লাভ বান হয়েছেন। শেরপুর খামার বাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন গনপদ্দি ব্লকের টিটিসি রোডের পাশে এক কৃষি মাঠে আলোক ফাঁদ স্থাপন অনুষ্ঠানে এসে সাংবাদিকদের জানান, আলোক ফাঁদ স্থাপনের এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। এবিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর জানান, মাঠ ফসলে ধীর গতিতে কাজ করলেও এ প্রযুক্তি পরিবেশ বান্ধব, অধিক কার্যকরী ও স্থায়ীত্বশীল। তাই আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে নকলার কৃষকরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। সুফল দেখে পর্যায়ক্রমে এর ব্যবহার বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, এই প্রযুক্তি সারাদেশ ব্যাপী সব ফসলের মাঠে ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে মোট শস্য ও ফসলের উৎপাদান কয়েক হাজার মেট্রিকটন বেড়ে যাবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *