মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) :
আমাদের খাদ্যাভ্যাসে চাল ও গমের প্রাধান্যই বেশি। তবে যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে সেতুলনায় চাল ও গম আপাতত উৎপাদন হলেও ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনগনের খাদ্য চাহিদা মিটাতে হিমশিম খেতে পারে খাদ্য বিভাগ। তাই চাল ও গমের ওপর চাপ কমাতে সাদা ভূট্টা চাষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কারন, সাদা ভূট্টা খেতে সুস্বাদু ও প্রেটিন সমৃদ্ধ। তাছাড়া আটা ও হলুদ ভূট্টার চেয়ে সাদা ভূট্টার দানা মিহি হওয়ায় পৃথিবীর বহু দেশে সাদা ভূট্টা অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে সমাদৃত। শুধু তাই নয়, এভূট্টা থেকে ৩০/৩৫ প্রকারের খাদ্য দ্রব্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। আর তাইতো শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোণা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ইউনিয়নের চাষিরা সাদা ভূট্টা চাষে ঝুঁকছেন। এ ভূট্টা চাষে অধিক লাভ দেখে অন্যসব ইউনিয়নের কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন। অনুর্বর জমি, মাত্র একটি সেচ, কম পুঁজিতে নামেমাত্র শ্রমে ও সরকারি সহযোগিতা পাওয়ায় উপজেলায় দিন দিন ভূট্টা চাষির সংখ্যা ও অনাবাদি জমিতে ভূট্টা আবাদের পরিমাণ বাড়ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, প্রায় শত বছর আগে থেকেই উপজেলায় বিভিন্ন দেশীয় জাতের অল্প পরিমাণে ভূট্টা চাষ করা হতো যার রং ছিলো হলুদ। তবে এবার উপজেলায় ২ হাজার ৫০ একর (৮২০ হেক্টর) জমিতে পাইওনিয়ার, এনকে-৪০, সুপার সাইন ও প্যাসিফিক জাতের ভূট্টার আবদ করা হয়েছে, যার অধিকাংশই সাদা জাতের। তার মধ্যে রাজস্ব খাতের ৫৬ টি ও পুষ্টি প্রকল্পের ৩ টি প্রদর্শনী প্লট রয়েছে। প্রতি একর জমিতে ১শ’ থেকে ১২০ মণ ভূট্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষকরা। তাতে উপজেলায় প্রায় ৯ হাজার মেট্রিকটন ভূট্টা উৎপাদন হবে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। আশানুরুপ ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষির সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। উপজেলার জালালপুর এলাকায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভূট্টা উৎপাদন কলাকৌশলের উপর এক মাঠ দিবসে উপস্থিত হয়ে ভূট্টা গবেষক ড. আলীম উজ্জামান ও ড. শামসুর রহমান বলেন, এ দেশে চেলি, এ-ক্রস, আলাজুয়েলা, পোজারিকা, সাভার-১, বণার্লী, শুভ্রা, সোয়ান-২, খই ভূট্টা, সিমীট কম্পোজিট ও সাদাফ সহ দেশীয় জাতের ভূট্টা বেশি চাষ হলেও সাদা জাতের ভূট্টা অধিক ফলনশীল ও পুষ্টি সমৃদ্ধ হওয়ায় কৃষকরা এভূট্টা চাষে আগ্রহী বেশি। তাছাড়া বিএআরআই গাজীপুরের গবেষণা বিভাগের পরিচালক ড. মোঃ লুৎফর রহমান ও আরএআরএস জামালপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. আব্দুল মালেক জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বারি উদ্ভাবিত হাইব্রিড সাদা ভূট্টার চাষ ছড়িয়ে দিতে সারা দেশের ন্যায় বারি’র গবেষণা বিভাগ শেরপুর অঞ্চল এবং উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ’র গম ও ভূট্টার উন্নততর বীজ উৎপাদন এবং উন্নয়ন প্রকল্প-২য় পর্যায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ড. শহিদুজ্জামান বলেন, ধান ও গম সি-থ্রি প্রজাতির শস্য কিন্তু ভূট্টা সি-ফোর প্রজাতির হওয়ায় ধান ও গমের তুলনায় ভূট্টার উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। যেখানে প্রতি হেক্টরে গম ৩ থেকে ৪ টন, ধান ৫ থেকে ৬ টন উৎপাদন হয়, সেখানে ভূট্টা উৎপাদন হয় ৮ থেকে ১০ টন। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে এদেশে বর্তমানে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে ২২ লাখ টন অধিক ক্যারোটিন সমৃদ্ধ তথা কম স্বাদ যুক্ত হলুদ ভূট্টা উৎপাদিত হয়। যার অধিকাংশ মুরগী, মাছ ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে সাদা ভূট্টার স্বাদ চাল ও গমের মাঝামাঝি হওয়ায় ভাত ও আটার পরিবর্তে সাদা ভূট্টার দিকে ঝুঁকছেন অনেক দেশের মানুষ। তাই হলুদ ভূট্টার পরিবর্তে সাদা ভূট্টার চাষ বাড়ালে চাল ও গমের ওপর চাপ কমবে। কোন একসময় এটি হতে পারে এদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল; বলছেন পুষ্টি বিজ্ঞানী ও ভূট্টা গবেষকরা।
কাজাইকাটা গ্রামের কৃষক নকলা হাজী জালমামুদ কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ, হুজুরি কান্দার রুবেল, কালাম, হালিম, রেজাউল, নারায়ন খোলার কৃষাণি তাসলিমা, বানেশ্বরদীর দেলোয়ার, ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সদস্য হেলাল, বেলাল, মোশারফ, ঈসমাইল, তাহমিনা সহ অনেক চাষি বলেন, সরকারি পৃষ্টপোষকতা বাড়ালে উপজেলার অনেক অনুর্বর ও অনাবাদি ৭শ’ হেক্টর জমিতে ভূট্টা চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাদের মতে, অনুর্বর ও অনাবাদি জমিতে ভূট্টা চাষ করলে একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার হবে, অন্যদিকে আসবে পুষ্টি ও টাকা ।
বিভিন্ন ব্লকে কর্মরত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ইসমাতুন মাসুমা জাহান, শহিদুল ইসলাম, আশ্রাফ উজ্জামান, আলতাফ হোসেন ও অবু বক্কর সিদ্দিক খান বলেন, নকলা উপজেলার সব ইউনিয়নেই ভূট্টা চাষ করা সম্ভব। তারা বলেন, ভূট্টা রবি ও খরিপ দুই মৌসুমেই চাষ করা যায়। দো-আঁশ মাটি ভূট্টা চাষের জন্য উৎকৃষ্ট। আশ্বিন থেকে অগ্রহায়নের মাঝামাঝি সময়ে রবি এবং ফাল্গুন থেকে চৈত্রের মাঝামাঝিতে খরিপ মৌসুমে সারি করে ভূট্টা বীজ বপন হয়। ভালো ফলনের জন্য রবি মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দিতে হয় তবে সাদা ভূট্টায় ১ বার সেচ দিলেই চলে। গোছা থেকে গোছার দুরত্ব ২৫ থেকে ৫০ সে.মিঃ এবং সারি থেকে সারির দুরত্ব ৫০ থেকে ৭৫ সে.মিঃ হওয়া উত্তম। মাটিতে বেশি রস থাকলে ২.৫ থেকে ৩.৫ সে.মিঃ এবং রস কম থাকলে ৫ থেকে ১০ সে.মিঃ নিচে বীজ বপন করতে হয়। তারা জানান, ভূট্টা চাষে প্রতি হেক্টরে ২২০ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ কেজি জিপসাম, ১১০ কেজি টিএসপি, ৫০ কেজি এমপি, ১০ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়াকে সমান দুই ভাগ করে গাছ গজানোর ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর প্রথমবার এবং ৬০ থেকে ৬৫ দিন পর দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করতে হয়। প্রয়োজনে সেচ এসময়েই দিতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ভূট্টা দানা শস্যের মধ্যে হেক্টর প্রতি ফলনে প্রথম, মোট উৎপাদনে দ্বিতীয় ও জমির পরিমাণে তৃতীয়। প্রধান ভূট্টা উৎপাদনকারী দেশ আমেরিকা, চীন, তারপর পর্যায়ক্রমে ব্রাজিল, রোমানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য।বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বত্রই ভূট্টা চাষ হলেও চট্রগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও শেরপুর এলাকায় বেশি চাষ হয়। পুষ্টি বিজ্ঞানের মতে ভূট্টাতে শতকরা ৭২ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ১০ ভাগ প্রোটিন, ৪ ভাগ চর্বি জাতীয় পদার্থ, ১.৩৬ ভাগ খনিজ পদার্থ এবং ১০ ভাগ পানি ও অন্যান্য পদার্থ আছে। আর ভূট্টাদানা থেকে স্টার্চ, চিনি, সিরাপ, তৈল, করণমিল, এলকোহল এবং কান্ড, পাতা, ডাটা থেকে কাগজ, কার্ড বা হার্ড বোর্ড, প্লাষ্টিক, এসিটিক এসিড পাইপ সহ বহুবিধ শিল্পজাত দ্রব্য তৈরী করা হয়।
মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ জানান, তিনি এবছর ২ একর জমিতে ভূট্টার আবাদ করেছেন। এতে প্রতি কেজি ৫১০ টাকা দামের ১১ কেজি ভূট্টা বীজ লেগেছে। তাছাড়া হুজুরি কান্দার রুবেল, কালাম, হালিম, রেজাউল, নারায়ন খোলার কৃষাণি তাসলিমা সহ অনেকেই জানান, যেসব জমিতে অন্য কোন শস্য আবাদ করা যায় না সেসব জমিতে ভূট্টা খুব ভালো হয়। তাই তারা এবছর ভূট্টার আবাদ বেশি করেছেন। বাজার জাত করা পর্যন্ত প্রতি একরে ৩১ হাজার থেকে ৩৩ হাজার টাকা করে তাদের খরচ হবে। খরচ বাদে দ্বিগুন লাভ হবে বলে তারা জানান। পাইকার ও রাখি ব্যবসায়ীরা বলেন, অন্যান্য শস্য কিনে রেখে দিলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু ভূট্টাতে তাদের লোকসান গুণতে হয়না। প্রতি পাইকার ২০০ থেকে ৩০০ মেট্রিকটন ভূট্টা কিনে পারর্শ্ববর্তী বিভিন্ন গো-খাদ্য, হেচারী ও ফিসারীর মালিকদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, ভূট্টা অধীক লাভ জনক ফসল হওয়ায় কৃষকরা অলাভ জনক অন্য আবাদ ছেড়েদিন দিন ভূট্টার দিকে ঝুঁকছেন। কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের প্রশিক্ষণ সহ সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর ভূট্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে এবছর উপজেলার ৮০ জন চাষীকে প্রনোদণা দেওয়াসহ ভর্তুকি মূল্যে ভূট্টা মাড়াই যন্ত্র ও বপনের জন্য বেড প্লেন্টার মেশিন বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ।