মোঃ নুর ইসলাম, দিনাজপুর থেকে ঃ গত ৩০ জুন মহান শান্তাল বিদ্রোহ দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে চাম্পাগড়ে সান্তালী ভাষা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংগঠনের আয়োজনে দিনাজপুর সদরের উত্তর গোবিন্দপুর (খাটাংপাড়া) সিধু কানু স্মৃতিস্তম্ভে ঐতিহাসিক সান্তাল বিদ্রোহ দিবসের র্যালী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সান্তাল বিদ্রোহ দিবসের সকল কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এ সকল কর্মসূচির মধ্যে সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে সিধু কানু স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্প স্তবক অর্পণ শেষে এক বর্ণাঢ্য ্র্যালী এলাকার সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সকাল ১১ টা ৩০ মিনিটে আলোচনা সভা এবং দুপুর ২ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সান্তালী ভাষা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংগঠনের মহাসচিব যোগেন জুলিয়ান বেসরা এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কসবা মিশনের ফাদার ভিনসেন্ট মুরমু, সুইহারি মিশনের ফাদার মাইকেল মুরমু এবং পল্লী বিদ্যুৎ মিশনের ফাদার শিমন হাঁসদা.টিওয়ার, চেলগাজী ইউনিয়নের পারগানা মিঃ শিরিল হেম্রম, মহিলা প্রতিনিধি লুচিয়া মার্ডি প্রমূখ। লুচিয়া মার্ডি এর উপস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেন সংগঠনের কোষাধক্ষ্য মাইকেল মার্ডি, সদস্য সালভাতর পাউরিয়া, রবি মার্ডি প্রমুখ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল “সাঁওতাল অভ্যুত্থান” তার নাম। ভারত বর্ষের পাকুড় জেলার পশ্চিমে ৪০ মাইল দূরের ভগনাডিহি গ্রামে সে সময় একটি অবস্থাপন্ন সাঁওতাল-পরিবার থাকত, ঘটনাচক্রে যারা ওই মহাজন শ্রেনীর সর্বপ্রথম বলি হয়েছিল। পরিবারটি ছিল চার ভাইয়ের। এদের নাম ছিল সিধু, কানু, চাঁদ আর ভৈরব; সীমাহীন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল তারা। সাঁওতাল কৃষক স¤প্রদায় গান গাইতে গাইতে হাতে তীর-ধনুক নিয়ে জমিদার, মহাজন ও সরকার-এই তিন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে খোলাখুলি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে পতাকা তুলল। চরম নির্যাতিত ও অপমানিত সাঁওতাল সমাজ সর্বসম্মতিক্রমে অন্যায় অত্যাচারের পরিবর্তে শান্তি ও নিরাপত্তার দাবি করল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরও রক্তপাত, শান্তিদান ও অশান্তি জিইয়ে রাখতে চাইল। এই অসম যুদ্ধে বহু সংখ্যক সাঁওতাল কৃষককে পণবন্দি ও কারারুদ্ধ করে রাখা হল।
এই সাঁওতাল মহা অভুত্থান নির্মমভাবে দমন করা হয়। এইখানেই সাঁওতালদের বা বস্তুতপক্ষে ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের কৃষকদের ওপর অত্যাচারের শেষ নয়। বরং এই অত্যাচার আরও তীব্রতর হল। এতদসত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে এই সাঁওতাল অভ্যুত্থান অনেকটাই সফল হয়েছিল। সাঁওতাল অঞ্চলকে প্রশাসনিক দিক দিয়ে টুকরো টুকরো করে প্রতিবেশী জেলাগুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল এবং সাঁওতাল পরগনা নামে পৃথকভাবে পুনঃ সংগঠিত করা হল। অতএব সাঁওতালরা জাতীয় পর্যায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে এক বিশেষ মর্যাদা আদায়
করতে সফল হয়েছিল।
অভ্যুত্থানের জন্য যে সব প্রকৃত সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তার কোলাহল থিতিয়ে এল। কিন্তু তার প্রতিধ্বনি বছরের পর বছর আরও সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও অধিক সংখ্যায় কৃষকরা জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দিল। ৩০ জুন, ১৮৫৫ সেই কালরাত্রিতে সাঁওতালরা ভগনাডিহিতে যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল, তা দেশের অন্যান্য প্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল, যার প্রতিধ্বনি ১৮৬০-এর নীলচাষীদের ধর্মঘট, ১৮৭২-এর পাবনা ও বগুড়ার বিদ্রোহ, ১৮৭৫-৭৬-এ পুণা ও আহমেদনগরের মারাঠা কৃষক অভ্যুত্থানের সময় শোনা গিয়েছিল। অবশেষে এর ফলশ্রুতি হিসেবে সারা দেশের কৃষক স¤প্রদায় জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক জোরদার দাবি তুলল। সাঁওতালদের রক্তে লেখা এই শ্লোগানে মোটা হরফে জ্বল জ্বল করতে লাগল। তারপর থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের এই আদর্শ জনে জনে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল।