সিভাসু গবেষণা তরী
কৃষি সংবাদ ডেস্কঃ
সিভাসু গবেষণা তরী ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের (সিভাসু) উদ্যোগে রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে নির্মিত বিশেষায়িত গবেষণাতরী উদ্বোধন করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার (২৮.১১.১৯) সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি এ গবেষণাতরী উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে গবেষণাতরীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম আজ থেকে শুরু হলো।
গবেষণাতরী উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গবেষণা প্রয়োজন। ভাসমান এ তরী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গবেষণাতরী উদ্বোধনকালে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, সিভাসু উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এম নূরুল আবছার খান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ।
এই গবেষণাতরীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে উন্মোচিত হলো নতুন এক মাইলফলক। কারণ, দেশে এই ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। এটি সিভাসু’র শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই গবেষণাতরীতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ ৩টি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।
বিশেষায়িত গবেষণাতরীর মাধ্যমে বহুমুখী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে মালয়েশিয়া সরকার তাদের কৃত্রিম হ্রদ ‘লেক কেনিয়র’-এর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আর সেই তরীর আদলে সিভাসু’র এই গবেষণাতরীটি নির্মাণ করা হয়েছে।
সতের (১৭) মিটার দৈর্ঘ্য ও সাত (০৭) মিটার প্রস্থবিশিষ্ট দ্বিতল এ গবেষণাতরীটির প্রস্তুতকারী দেশ সুইডেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরীক্ষামূলকভাবে এটি কাপ্তাই লেকে নামানো হয়। গবেষণাতরীটির স্থিতিশীলতা ও হাল কাঠামো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগ দ্বারা পরীক্ষিত ও অনুমোদিত।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে কাপ্তাই লেকের অনেক মৎস্যপ্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির আশংকায় আছে। বিলুপ্ত মৎস্যপ্রজাতির মধ্যে রয়েছে-মহাশোল, পিপলা শোল, বাঘাআইড়, নান্দিনা ইত্যাদি। বিলুপ্তির আশংকার তালিকায় আছে- সরপুঁটি, পাবদা, গুলসা, বাচুয়া ও ভঙ্গন বাটা প্রভৃতিসহ ১৮টি প্রজাতি। কাপ্তাই লেক এক সময় কার্প জাতীয় মাছের প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ১৯৬৫-৬৬ সালে এই হ্রদে প্রাপ্ত মাছের মধ্যে ৮১ শতাংশই ছিল কার্প জাতীয়। অথচ বর্তমানে ৯০ শতাংশই হলো চাপিলা ও কাচকি।
লেকের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গাছপালা উজাড় করে ফেলায় ভূমিধস হচ্ছে এবং তাতে লেকের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। এর পাশাপাশি দৈনন্দিন বিপুল পরিমাণ মনুষ্য বর্জ্য এবং অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। লেকের চারপাশের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ পানীয়জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্য এ লেকের পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় হ্রদের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে লেকের গতিপথ-যা ব্যাহত করছে মাছের অভয়াশ্রম ও প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ। এছাড়া, সাম্প্রতিককালে লেকের চারপাশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় জলজপ্রাণীর ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এখনই যদি কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া না যায়- তাহলে লেকের মৎস্য ও অন্যান্য জলজপ্রাণী ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
তাই কাপ্তাই লেকের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও এর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন ফলপ্রসূ গবেষণা। আর এ তাগিদ থেকেই সিভাসু কর্তৃপক্ষ উক্ত গবেষণাতরী নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
অন্তত ১৫টি কাজ নিয়ে লেকে নামবে এই গবেষণাতরীটি। এর মধ্যে অন্যতম হলো লেকের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের স্টক অ্যাসেসমেন্ট, মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য স্থান নির্বাচন, সময়ের সঙ্গে লেকের বিভিন্ন ভৌত রাসায়ানিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা, বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, লেকের চাষযোগ্য সম্ভাব্য প্রজাতি বের করা, বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা নিরূপণ, প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ ও পদক্ষেপ নেওয়া, স্থানীয় জনশক্তিকে খাঁচায় ও পেন কালচারের মাধ্যমে মাছ চাষে উদ্যোগী করা, ঘোনায় মাছ চাষের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো যাচাই। এছাড়া লেকের মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের বিস্তৃতির বর্তমান অবস্থা নিরূপন ও প্রকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে করণীয় বিষয় নির্ধারণ, লেক ভরাট হওয়ার জন্য দায়ী কারণগুলো বিশ্লেষণ ও নিরূপণে উদ্যোগ নেওয়া, লেকের দূষণ দূরীকরণে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও করা হবে এ গবেষণাতরীর মাধ্যমে।
এ তরীর মাধ্যমে বহুমুখী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে কাপ্তাই লেক ও এর জীববৈচিত্র্যকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।