জেনে নিতে পারেন সুগন্ধি গাছ পুদিনা পাতার চাষ করার পদ্ধতি

podina pata cash
মৃত্যুঞ্জয় রায়

আশ্চর্য ওর নাম! বাংলা, হিন্দী, উর্দু, মারাঠী, গুজরাটী, পাঞ্জাবী, তেলেগু, তামিল সব ভাষাতেই ওর এক নাম- পুদিনা। এমনকি নেপালেও গাছটা পুদিনা নামে পরিচিত। পুদিনা সুগন্ধি গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই পুরনো একটা ছড়ার মধ্যেও বাজার থেকে পুদিনা পাতা কেনার ফরমায়েশ পাওয়া যায় ‘পুদিনা আনিও, পান আনিও।’ খাদ্যকে সুরেচক করতে পুদিনা পাতার কোনো জুড়ি নেই। শহরাঞ্চলে দিন দিন পুদিনা পাতার চাহিদা বাড়ছে। তাই বোধ হয় পুদিনাকে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার সময় এসে গেছে। সুদুর অতীত থেকেই এ দেশে পুদিনা পাতা জন্মে আসছে। কিন্তু সে চাষ আদৌ বিজ্ঞানভিত্ত্কি নয়, কোনোভাবে বাড়ির আঙিনায় দুচারটা গাছ লাগিয়ে পারিবারিকভাবে ব্যবহার করা। আজকাল বাজারে যেভাবে আঁটি আঁটি পুদিনা পাতা সারা বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে তাতে আর এখন পুদিনাকে শুধু বাড়ির আঙ্গিনাতে আটকে রাখা ঠিক হবেনা, চাইলে মাঠে অন্যান্য ফসলের মতো বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যাবে। এমনকি বিদেশেও পুদিনা পাতার চাহিদা আছে। রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও সুযোগ হতে পারে। পুদিনা পাতার উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হতে পারে পিপারমিন্ট অয়েল উৎপাদন শিল্প। দাম ভাল থাকায় এ দেশের ক্ষুদ্র চাষিরা পুদিনার চাষ করে অল্প জমি থেকেই বেশি আয় করতে পারেন।

গাছের পরিচয়
পুদিনা একটি সাধারণ আগাছা ধরনের গাছ। বিরুৎ প্রকৃতির গাছ। কাণ্ড ও পাতা বেশ নরম। কাণ্ডের রঙ বেগুনি, পাতার রঙ সবুজ। পাতা ডিম্বাকার, পাতার কিনারা খাঁজকাটা। পাতা কিছুটা রোমশ ও মিন্টের তীব্র গন্ধযুক্ত। গাছ উচ্চতায় ৫০-৯০ সেন্টিমিটার। কাণ্ড কিছুটা শক্ত। গাছের নীচের অংশ থেকে অনেক ধাবক বা রানার বের হয়। গাছ বেশ কষ্ট সহিষ্ণু। বেশ দ্রুত বাড়ে ও ঘন ঝোপ তৈরি করতে পারে। পুদিনা পাতার গাছ লেবিয়েটিসি পরিবারের মেন্থা গণের অন্তর্গত। এ গণের ৩টি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে গবহঃযধ ধৎাবহংরং এ দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাল জন্মে। জাপানী জাত চাষের জন্য ভাল।

ব্যবহার
পুদিনা পাতার গাছ থেকে পিপারমেণ্ট তেল তৈরি হয়। সে তেলটা বেশ মূল্যবান। বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী বিশেষ করে টুথপেষ্ট, মিন্ট চকলেট ইত্যাদিতে তা ব্যবহার করা হয়। তাই পুদিনা গাছের শিল্পমূল্য অনেক বেশি। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১০ টন পিপারমেন্ট তেলের শিল্প চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। এই পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১০ হাজার একর জমিতে পুদিনা উৎপাদন করতে হয়। কিন্তু উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার পিপারমিন্ট অয়েল তাদের বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের বাজারে মূলত কাঁচা পুদিনা পাতার চাহিদাই বেশি। প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ১৮০০০ মেট্রিক টন কাঁচা পুদিনা পাতার চাহিদা রয়েছে।
পুদিনা এ দেশে চাষ হয় মূলত চাটনি, সালাদ আর বোরহানী বানানোর জন্য। এর যে অন্য আরও অনেক ব্যবহার আছে সেটাই হয়তো আমরা জনিনা। কাঁচা পুদিনা পাতার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় চাটনি ও সালাদে। ইদানীং বিভিন্ন পার্টিতে টক দইয়ের বোরহানী তৈরির জন্য পুদিনা পাতার ব্যবহার বেড়েছে। এ ছাড়া মাছ, মাংস, সস, স্যুপ, স্টু, চা, তামাক, শরবত ইত্যাদি মুগন্ধি করতে পুদিনা পাতা ব্যবহার করা হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ভেড়ার মাংসের রোস্ট ও মিন্ট জেলী তৈরি করতে পুদিনা পাতা ব্যবহার করা হয়।
তবে বিভিন্ন দেশে পুদিনার বেশি ব্যবহার তেল তৈরিতে। গাছে যখন ফল আসে তখনই পাতায় তেলের মাত্রা বাড়ে। ওই সময় গাছ তুলে পাতন প্রক্রিয়ায় তেল নিষ্কাশন করা হয়। গাছের নিচের পাতা হলদে হওয়া শুরু করলেই কাটিং নিয়ে দিল্লিতে তেল নিষ্কাশন করা হয়। মৌসুমে একই গাছ থেকে দুবার কাটিং সংগ্রহ করা যায়। কাটিংগুলোকে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে ঝুলিয়ে শুকানো হয়। কাঁচা পাতার চেয়ে শুকানো পাতা থেকে তেল নিষ্কাশন সহজ ও সস্তা। তেলের রঙ সোনালী। তেলে ৫০ পিপিএম পিপারমিন্ট থাকে।

কাটিং বা তেউড় লাগিয়ে চারা তৈরি করা হয়। পুরনো ক্ষেত থেকে কাটিং নিয়ে হাপরে বসিয়ে চারা তৈরি করে নিতে হবে। কাটিংয়র দৈর্ঘ্য হবে ১০ সেন্টিমিটার। জমিতে চারা রোপণের সপ্তাহখানেক আগে চারা তৈরি করতে হবে। কেননা, কাটিংয়ে শিকড় গজাতে মাত্র ৭ দিন সময় লাগে। জমি চাষের সময় জমির মাটির সাথে প্রচুর পরিমাণে (১০-১৫ টন গোবর/হেক্টর) জৈব সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করার পর চারা রোপণের আগে ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার চওড়া করে বেড তৈরি করতে হয়। বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেন্টিমিটার। প্রতি বেডের মাঝে নালা থাকবে। বেডের দৈর্ঘ্য জমির আয়তন অনুসারে কম-বেশি হতে পারে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বেডের আকার একটু অন্যরকম হবে। এ ক্ষেত্রে বেড ১ মিটার চওড়া ও ৪৫ মিটার লম্বা হবে। অর্থাৎ প্রতি বেডের আয়তন হবে ৪৫ বর্গমিটার। এ পরিমাণ জমির জন্য গোবর বা কম্পোস্ট সার লাগবে ২০ ঝুড়ি (২০০ কেজি), হাড়ের গুঁড়া ৫ কেজি, টিএসপি সার ১-১.৫ কেজি, কাঠের ছাই ৫ কেজি অথবা এমওপি সার ১ কেজি। এসব সার বেড তৈরির সময় বেডের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বর্ষার আগে ও পরে চারা রোপণের নিয়ম। সে অনুযায়ী জুন অথবা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পুদিনার চারা রোপণ করা যেতে পারে। বেডে ৩০ সেন্টিমিটার পর পর চারা রোপণ করা যেতে পারে। চারা রোপণের পর সেচ দিতে হবে। প্রতি ২ মাস পর পর প্রতি বর্গমিটারে ২০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। গাছ লম্বা হতে শুরু করলে ১০ সেন্টিমিটার মাপের কাটিং বা ডাল কেটে ১০-১৫টি ডাল একটি আঁটিতে বেঁধে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাতে হবে। প্রতি দুবার কাটার পর একই নিয়মে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার দেয়ার পর সেচ দিতে হবে। বাণিজ্যিক জমিতে চারা রোপণের ১০-১২ সপ্তাহ পর থেকে প্রতি মাসে একবার করে প্রতি বর্গমিটারে ২০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করে যেতে হবে। সারা বছর ধরে পুদিনা চাষ করা ও তোলা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *