এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট অফিস :
উপকূলবর্তী কোটি মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে ঃ সুন্দরবনের উপকূলবর্তী কোটি মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরন সংলগ্ন উপকূলবর্তী নদী প্রতিনিয়ত অব্যাহত ভাঙনে তছনছ করছে এলাকা। নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আর এসব দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে এ এলাকার বাসিন্দারা। জানা যায়,১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা পর্যন্ত উপকূলবাসীর ঝুঁকির অবসান হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু করার থাকে না। যদিও মহসেন ও হুদহুদ নামক ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কগ্রস্ত করতে পারেনি। দক্ষিণ জনপদের নয় জেলার অন্তত এক কোটি মানুষ মারাত্মক দুর্যোগের মধ্যে বসবাস করছে। প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় উপকূলবাসীদের দুর্যোগের সময় নিরাপদ স্থানে ঠাঁই নেয়ার সুযোগ থাকে না। ১৯৯২ সালের উপকূল এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র্র নির্মাণের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।
‘৭০ সালে ঘণ্টায় ১৯৬ কি.মি. বেগে ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসেবে তিন লাখ, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘণ্টায় ২২৫ কি.মি. বেগের ঘূর্ণিঝড়ে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ’৭০’র ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রাপ্ত সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার হলে কাক্সিক্ষত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব হতো। ’৯১’র অগ্রিম বিপদ সংকেত প্রচারিত হলেও ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতার অভাব ও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। দুর্যোগে জীবন ও সম্পদহানি মোকাবিলায় মহাপরিকল্পনা নেয়া হয় ১৯৯২-৯৩ সালে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের তদারকিতে এ পরিতল্পনার আওতায় কুয়েট ও বিআইডিএসের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ দল ’৯২ সালের পর থেকে ১০ বছরের মধ্যে সাড়ে তিন হাজার আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে উপকূলের মানুষের মধ্যে ঝুঁকি আর কমেনি। উপকূলে দুর্যোগ আতঙ্ক বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের প্রবণতা বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এর মধ্যে অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উপকূলীয় এলাকায় মওসুমী জলবায়ুর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দেশের উপকূলবর্তী নয় জেলার অন্তত এক কোটি মানুষ বছরের সারা মওসুমই মারাত্মক দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হচ্ছে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, বরিশাল ও পটুয়াখালী। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর ঘণ্টায় ২২০-২৩০ কি.মি. বেগে বয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনসহ দক্ষিণ জনপদের নয় জেলা ল-ভ- হয়ে যায়। সিডর মধ্যরাতের দিকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অতিক্রম করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে উত্তরে আসামের দিকে দুর্বল হয়ে পড়ে। গোটা উপকূল এলাকায় মধ্যরাত পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকে। তিনদিন ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রস্তুতির পর ও মানুষের জান-মাল রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। নিম্নাঞ্চল থেকে বহু মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারেনি। বহু জেলেকে সাগর থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বহু মানুষের কাছে সময়মতো পৌঁছায়নি মহাবিপদ সংকেতের খবর। ঘূর্ণিঝড়ের একদিন আগে ৪নং হুঁশিয়ারি সংকেত থেকে এক লাফে ১০নং মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করায় আশ্রয় কেন্দ্রে আসার প্রস্তুতি নিতে পারেনি দুর্গম এলাকার মানুষ। অনেকেই পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে যেতে চাইনি। উপকূলের দুর্গম এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় বহু মানুষ সেখানে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে সেখানে লোকজন যেতে পারেনি। সিডরের আঘাতে দক্ষিণ জনপদে সরকারি হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার ৩২ জন। দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাট ও খুলনার উপকূলীয় এলাকা এবং চরগুলোতে কয়েক লাখ মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যুগের পর যুগ বেঁচে আছে। দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের রক্ষা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
কোস্টগার্ড এবং ইক্যুইটি এন্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপের এক প্রকাশনায় বলা হয়,বাগেরহাটে ৮২টি, খুলনায় ৩৪টি, সাতক্ষীরায় ৪৮টি, বরগুনায় ৭০টি, বরিশালে ৫৭টি, ভোলায় ২০৮টি, ঝালকাঠিতে ২৬টি, পটুয়াখালিতে ১৯৬টি এবং পিরোজপুরে ১৯৬টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটিতে সর্বোচ্চ এক হাজার মানুষ দুর্যোগের সময় আশ্রয় নিতে পারে। ১৯৯১ সালে সাইক্লোনের সময় উপকূলবর্তী এলাকায় চার হাজার আশ্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল। প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়েনি। আশ্রয় কেন্দ্রের স্বল্পতার কারণে ১৫ নবেম্বর সিডরের ছোবলে দক্ষিণ জনপদে এত বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মাঝের চরের বাসিন্দা বাচ্চু জানান, সিডরে এই চরে দুইশ’ মানুষের প্রাণহানি হয়। উপকূলবাসীদের জীবন রক্ষার জন্য আজও পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হয়নি।