১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবসঃ কৃষিতে কৃষিবিদদের অবদান অনস্বীকার্য

কৃষিতে কৃষিবিদদের অবদান অনস্বীকার্য

 

মো. বশিরুল ইসলাম

কৃষি নিয়ে আমার পড়াশোনা। এটা নিয়ে এখন গর্ব করি। উচ্চগলায় বলি, আমি কৃষিবিদ। এখন যেভাবে উচ্চগলায় বলছি-ছোট বেলায় আমি কেন, যদি কারো কাছে জানতে চাওয়া হত বড় হলে তুমি কী হতে চাও? সকলের মত আমারও উত্তর ছিল ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সময় আমার রেজাল্ট খুব একটা খারাপ না হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মতো রেজাল্ট ছিলনা। খুবই হতাশা চলে এসেছিলো নিজের মাঝে। এই হতাশার গল্পটা আরো বড় হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। বড় ভাই আর মেঝ ভাইয়ের পরামর্শে কিছুটা শঙ্কা নিয়ে ভর্তি হলাম শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে। আমি সেদিনের আগে জানতামই না, কৃষি নিয়ে আমি অর্নাস পড়বো- আর তাই আমি এটাও জানতাম না যে আমার ভবিষ্যৎ কী হবে!
কৃষিতে পড়ালেখা করে বুঝতে পারলাম- এদেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থে কোন পেশার লোক যদি বেশি কিছু দিতে পারে-তা হল কৃষিবিদরা। ৭ কোটি মানুষের দেশে খাদ্যের অভাব ছিল, আজ ১৬ কোটি মানুষ ভালো মতোই খেতে পারছে। কৃষিবিদ তথা কৃষিবিজ্ঞানী কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তি ও অধিক উৎপাদনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করে কৃষক আজ ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে চলেছে। আমরা যদি অন্যান্য পেশার সাথে কৃষি পেশাকে তুলনা করি, তাহলে দেখব কৃষিবিদদের গবেষনা সরাসরি দেশ উন্নয়নে কাজ করছে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

কৃষিবিদরা কৃষকদের বিনামূল্যে সেবা দিয়ে থাকেন। তারা মাঠে গিয়ে কৃষি সমস্যা নির্নয় করে সে বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শুধু পরামকল্যানে কৃষিবিদরা ছুটে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, কৃষকের হৃদয়ের কাছে। যেখানে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে গর্বিত ইতিহাস, কৃষি ক্ষেত্রে কাঙ্খিত সফলতার ইতিহাস। আর তাই এখন সবাই বলেন গ্রাম আর এখন সে গ্রাম নেই, বদলেছে এর অনেক কিছু। সে সাথে বদলে গেছে মানুষের যাপিত জীবন।

কৃষিবিদরা কৃষির উৎকর্ষতার জন্য গবেষণা করেন, গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত হয় নতুন প্রযুক্তি, আর সে প্রযুক্তি মাঠে সম্প্রসারণও করেন কৃষিবিদরা। কৃষিবিদদের হাতেই সৃষ্টি হয় ফসলের নতুন জাত কিংবা ফসলের উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি। শুধু ফসল কেন, ফসলের পাশাপাশি গবাদিপশুর উন্নয়ন, দুধের মান ও পরিমাণ বাড়ানো, মাংসের জন্য উন্নত জাতের পশুপালন প্রযুক্তি, বিভিন্ন ধরনের মাছের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিকীকরণ, কিংবা কৃষির সব ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ; এসবই কৃষিবিদদের ু হাতের স্পর্শে প্রাণ পায়। উজ্জীবিত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই। এভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় এদেশের মেরুদ- বলে খ্যাত কৃষকের অর্থনৈতিক অবকাঠামো।

একসময় কৃষকরা যেমন ছিল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার, তেমনই কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু কৃষিবিদেরাও ছিল সামাজিক অবহেলা তথা অমর্যাদার শিকার। স্বাধীনতার আগে স্নাতক শেষ করে চাকরিতে যোগদানের সময় কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হতো। ফলে স্বাধীনতার আগে থেকেই চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীদের মতো কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়ার দাবি ওঠে। এ সময় দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মলয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ভালো করেই জানতেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ ও উৎকর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশেষে সেই আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়েছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করে পে-স্কেল সংশোধনের ব্যবস্থা নেন। এরপর থেকে প্রথম শ্রেনীর সুবিধা সমূহ পে-স্কেলের মাধ্যমেও স্বীকৃত হয়। এর ফলশ্রুতিতে কৃষিবিদরা যেমন সম্মানিত হয়েছে তেমনি দেশে কৃষিরও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাতে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আবাদি জমি দিনদিন কমার পরেও, জনসংখ্যা ২গুণ বাড়লেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। সেদিন এ ঘোষণা না হলে অর্থাৎ কৃষিবিদদের পদমর্যাদা উন্নত না হলে আজও এদেশের কৃষি থাকত সেই তিমিরেই। কারণ সে মর্যাদা পেয়েই দেশের উৎকৃষ্ট এবং মেধাবী সন্তানেরা এসেছে কৃষি শিক্ষায়।
কালের পরিক্রমায় কৃষি গ্রাজুয়েটরা কৃতজ্ঞতাস্বররূপ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন । যদিও ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আবার দ্বিতীয় শ্রেনীতে রূপান্তরের চেষ্টা চালালে কৃষিবিদ সহ দেশ বরেন্যরা এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ায় জিয়াউর রহমান তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। এমনকি যারা ক্ষমতায় আসে তারা আবার কৃষিবিদদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করে। এরপর বিভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে এই বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ’-এর তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান সংসদ সদস্য কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের একান্ত চেষ্টায় এই দিনটিকে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে সাথে ২০১১ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে কষ্ট হলেও কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আজ বিশের¦ দরবারে একটি রোল মডেল। বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থান হচ্ছে- ফসলের জাত উৎপাদনের ১ম, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, সবজি আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধিতে ১ম, ধান আর চা উৎপাদনে ৪র্থ, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনের ৮ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। শুধু কী তাই, বর্তমানে ব্লাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রফতানি হচ্ছে বিদেশে।
বাংলার কৃষক আর কৃষিবিদরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। আরো কত নিত্যনতুন সফলতার হাতছানি আমাদের ডাকছে শুভ সুন্দর আগামীতে। সবই কৃষিবিদদের ঐকান্তিক চেষ্টার সফলতা পেয়েছে।

আমাদের দেশের অনেক যোগ্য ও প্রতিথযশা গবেষকরা কৃষিকাজে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ভাল ফলও পাচ্ছেন কিন্তু দেখা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষনার ফলাফল জার্নাল বা পাবলিকেশানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আমাদের গবেষকদের এই অর্জনগুলো তৃনমুল পর্যায়ে পৌছে যাক, সেই সাথে নিরাপদ খাদ্যের যোগান নিশ্চিতের মাধ্যমে কৃষিবিদগণ সুস্থ-সবল ও মেধাবী জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে-এতে উপকৃত ও উন্নত হবে এদেশ। আর কৃষিবিদরা হয়ে থাকবে জাতির ইতিহাসে চিরস্মরনীয়।

লেখকঃ
জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *