মো. বশিরুল ইসলাম ঃ
আধুনিক কৃষি শিক্ষার মাধ্যমে এদেশের কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৩৮ সনে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটের রূপান্তর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অত্যন্ত গৌরবের বিষয়-এ বিশ্ববিদ্যালয় আজ ১৫ বছর জ্ঞান বিতরণ করে ১৬ বছরে পদার্পন করল। পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এ ইতিহাস মাত্র ১৫ বছরের হলেও উপমহাদেশের প্রচীনতম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর ইতিহাস দীর্ঘ ৭৮ বছরের। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মূলত উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর শেরেবাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার প্রথম কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেন। যার নাম দেওয়া হয় দি বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ইংল্যান্ডের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কারিকুলাম অনুসরণপূর্বক ১৯৪১ সালে ইনস্টিটিউট এর একাডেমিক যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন মুসলমান ও ১০ জন হিন্দু ছাত্র নিয়ে বি.এসসি.এজি কোর্স শুরু হয়। এরা দুই বৎসর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোতে লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়ে মেধা ভিত্তিতে বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটের গিয়ে ভর্তি হতে পারত। দুই বৎসর কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয় ওপর পড়ালেখা করে পরীক্ষা পাশের পর কৃতি শিক্ষার্থীরা জেলা কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে চাকুরী করতে পারত। এরাই ১৯৪৩ সালে বাংলার প্রথম কৃষি গ্রাজুয়েট। ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষে আই.এসসি পাশের পর ত্রিবার্ষিক বি.এজি ডিগ্রী কোর্স চালু করা হয়। যদিও মৌলিক অনুষদের মর্যাদা তখনও অক্ষুন্ন থাকে। তার সাথে চার বৎসরের কোর্সটিও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে ১৯৪৮ সালে পুরাতন ও নতুন মিলে দুটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একই বছরে ডিগ্রী পায়। ১৯৫১ সালে এম.এজি কোর্স চালু করা হয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট, পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধিন হওয়ার পর এর নাম রাখা হয় বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। তবে সর্বসাধারণের কাছে এটি ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত না পেয়ে ‘কৃষি কলেজ’ হিসেবেই খ্যাতি লাভ করে। এদেশের দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের অন্নের সংস্থান, কৃষিশিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণে এ ইনস্টিটিউটের গ্রাজুয়েটগনই অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। অথচ এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ১৯৬৪ সালে এ ইনস্টিটিউট কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভূক্ত কলেজ হিসাবে শিক্ষ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশ কৃষি ইন্সটিটিউটকে (বিএআই) স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ঘোষণা দিলেও ১৯৯০ সালে পরবর্তী সরকার তা বাতিল করে। বিএআই যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে যায়। ২০০১ সালের ৬ জানুয়ারি বিএআই হীরকজয়ন্তি অনুষ্ঠানে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন এবং ৯ জুলাই, ২০০১ সালে সংসদে আইন পাস করে। ১৫ জুলাই, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রফেসর মো. শাদাত উল্লাকে প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর বর্তমান সভাপতি ও অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র কৃষিবিদ আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম এমপি, মো. মহবুবউজ্জামানসহ বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন গ্রাজুয়েটদের নিরলস চেষ্টা ও অকৃত্রিম সেবার দ্বারাই বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির ভিত্তিমূল রচিত হয়েছে। ১৯৪৩ সাল থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব গ্রাজুয়েট পাশ করেছে মূলত তারাই সূচনা করেছে এদেশের কৃষি গবেষণা কার্যক্রমের। ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটরা কৃষকের সাথে মিলেমিশে এদেশের কৃষিকে চলমান রেখেছিলেন যার ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সময় এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তাদের অংশগ্রহন ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও গৌরবময়। জানা যায়, তৎকালীন সময়ে পুলিশি হয়রানী থেকে রক্ষা পেতে ঢাকার ছাত্রনেতারা আশ্রয় নিতেন এ প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের অংশগ্রহণও ছিল লক্ষ্যণীয়।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদ, এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদ, এ্যানিম্যাল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ৩০ াট বিভাগ রয়েছে। স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি তিনটি কোর্স চালু রয়েছে। তিনটি কোর্সে তিন হাজার তিন শত শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পাস করে দেশ-বিদেশে কৃষি উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমোট শিক্ষক সংখ্যা ২৩৪, কর্মকর্তা ২১০। শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার জন্য রয়েছে পাঁচটি খামার । বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পাঁচটি হল রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ছেলেদের এবং দুটি মেয়েদের জন্য বরাদ্দ।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্ররা রিসার্চ সিস্টেম (সাউরেস) এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া কে›ন্দ্রীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে গবেষণা করে নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। আর শেকৃবি বহিরাঙ্গন বিভাগ কৃষি প্রযুক্তি কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে সাউ সরিষা-১, সাউ সরিষা-২, সাউ সরিষা-৩, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আলুবীজ ও পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে সফলতা, টমেটো, টমাটিলো, রুকোলা, জামারুসান মূলা, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিভিন্ন বিদেশী ফুলের উৎপাদন সফলতা উল্লেখযোগ্য। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এ এস এম কামাল উদ্দিন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিলেন অমৃত কলার চাষ। তিনি পেঁপে ও আনারসের লাগসই চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। ড. নূর মোহাম্মদ মিয়া ও ড. ছিদ্দিক আলীসহ অনেক কৃষিবিদ উচ্চ ফলনশীল ধান বি.আর-৩, বি আর-৪, বিআর-১০, বি আর-১১, বি আর-১৪, বি.আর-১৯, বি.আর-২৩ জাত আবিষ্কার করে শুধু নিজ দেশে নয় প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, পশ্চিম আফ্রিকায় স্বীকৃতি পেয়েছেন। কাজী পেয়ারার জনক ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এ বিশ্ববিদ্যালযেরই ছাত্র । ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এবং ড.এস.এম জামান নামে দুজন কৃষি বিজ্ঞানী বাংলাদেশ সরকারের ‘সায়েন্টিস্ট এ্যামিরিটস’ পদে ভূষিত হয়েছিলেন। তাছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কৃষিতে অবদান রাখার জন্য এ প্রতিষ্ঠানের অনেক গ্রাজুয়েট স্বাধীনতা পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, বিজ্ঞান একাডেমিক স্বর্ণপদক ও শেরেবাংলা পদকসহ বিভিন্ন ধরনের পদক লাভ করেন।
স্বাধীনতার সময় এ দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে প্রায় ১৭ কোটি। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। আর এ নতুন নতুন জাত কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে কৃষিবিদরা, যার ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
রাজধানীতে অবস্থিত এ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিশিক্ষা,গবেষণায় তথা কৃষি উন্নয়নে অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরি করে দেশকে আরোও এগিয়ে নিয়ে যাবে- প্রতিষ্ঠা বাষির্কীতে এটাই কাম্য।