মো. মোশারফ হোসেন, শেরপুর প্রতিনিধি:
শেরপুরের নকলায় ধান কাটা শ্রমিকের আকাল পড়েছে। ২ মণ ধানের দামেও মিলছেনা একজন ধানকাটা শ্রমিক। চলতি মৌসুমে মাঝে মধ্যে ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষক। তাছাড়া ধান কাটতে গিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত শ্রমিক। আর যাও মিলছে, প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। যেখানে একমণ ধানের বর্তমান বাজার মূল্য ৪৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা, সেখানে একজন ধানকাটা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বাবদ কৃষককে গুণতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ টাকা। তার মানে ২ মণ ধানের দামেও একজন শ্রমিকের দাম মিটানো যাচ্ছে না। এক দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে মানব সৃষ্ট শ্রমিক সংকটের কবলে পড়ে কৃষকরা আজ দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ পাকা ধানের ক্ষেত বর্গা দিয়ে দিচ্ছেন।
উপজেলার মমিনাকান্দা এলাকার মোহাম্মদ হযরত আলীসহ বেশ কয়েকজন কৃষক তার খেতের ধান শ্রমিকের অভাবে কাটতে না পেরে, শুধু কাটা ও মাড়াই করে দিতে শ্রমিকদের অর্ধেক ধানের বিনিময়ে অর্থাৎ বর্গা হিসেবে দিয়েছেন। এতেকরে কৃষকের জমি, বীজ, জমি তৈরী, চারা রোপন, নিড়ানি, সার, কীটনাশক, সেচ ও নিজের শ্রম খরচসহ অন্যান্য খরচ করার পর যা পাচ্ছেন; শ্রমিকরা শুধু কেটে এনে মাড়াই করেই তা পাচ্ছেন। এতে সুস্পষ্ট যে, আগামীতে এসব কৃষক আর ধান রোপন করবেন না। তাই সরকারকে এবিষয়ে এখনই নজর দিতে হবে বলে মনে করছেন সুশীলজন। যদিও কেউ কেউ বলছেন শ্রমিক সংকট দেখা দেওয়া একটি দেশের জন্য ভালো লক্ষন। কারন হিসেবে জানান, মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন হচ্ছে বলেই তারা শ্রম বিক্রি বন্ধ করে দিচ্ছে, ফলে দিন দিন শ্রমিক সংকট বাড়ছে।
ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যান সংস্থার সভাপতি আলহাজ্ব মো. ছায়েদুল হকসহ বেশ কয়েকজন কৃষক সদস্য জানান, তাদের ধান খেতে পানি না থাকায় মজুরি কিছু কম হলেও, ধানের দর পতনের কারনে বিঘা প্রতি তাদের লোকসান হচ্ছে প্রায় হাজার টাকা। অনেক কৃষক তাদের আবাদ করা একবিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে খরচের হিসেব দেন এইভাবে- সেচ বাবদ এক হাজার ২০০ টাকা, জমি তৈরী ৮০০ টাকা, রোপন করা ৯০০ টাকা, ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, কুমুলাস, দানা ও তরল কীটনাশক, কাটা ও মাড়াইসহ ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। আর এক বিঘা জমিতে উৎপদিত ধানের বর্তমান বাজার মূল্য ১০ হাজার ১১ হাজার টাকা। তাদের দেওয়া হিসেব মতে নিজের শ্রম মূল্য বাদেও প্রতি বিঘাতে অন্তত হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। তাই তাদে মধ্যে অনেকে আগামীতে ধানের পরিবর্তে অন্য আবাদের পরিকল্পনা করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলায় এবছর ১৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল। কিন্তু আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৪৫ হেক্টর বেশি। এরমধ্যে উফশী জাত ৫ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, এ জমিতে উৎপাদিত ধান থেকে চাল পাওয়ার জাতীয় হিসেবে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৩.৯২ মেট্রিকটন করে ২০ হাজার ৯৫২ মেট্রিকটন। হাইব্রীড জাত ৭ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, এতে উৎপাদিত ধান থেকে চাল পাওয়ার লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৪.৭৫ মেট্রিকটন করে ৩৭ হাজার ৬২০ মেট্রিকটন এবং স্থানীয় জাত অন্তত ২৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, এতে উৎপাদিত ধান থেকে চাল পাওয়ার লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ১.৯৪ মেট্রিকটন করে ৫৩ মেট্রিকটন।
১৭ মে রাত্রে ও ১৮ মে শুক্রবার সকালে জালালপুর ম্যানেজার মার্কেট, হাজী জালমামুদ কলেজ গেইট, গড়ের গাঁও মোড়, গনপদ্দী বাজার, ছাল্লাতুলা নতুন বাজার, কায়দা মোড়, চেরুর বাজার, শিববাড়ি বাজার সহ বেশ কিছু শ্রমিক হাটে গিয়ে জানা গেছে পাশ্ববর্তী জেলা জামালপুর, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, রৌমারী, রংপুরসহ অপেক্ষাকৃত শ্রমিক সহজপ্রাপ্য এলাকা থেকে শ্রমিকরা এসে বিভিন্ন অফিস, স্কুল, কলেজ বা কোন ভবনের বারান্দায় রাত্রি যাপন করে কিছু দিনের জন্য শ্রম বিক্রি করতে আসছেন। বরাবরের ন্যায় মজুরি বেশি পাওয়ার আশায় তারা নকলায় কাজের খোঁজে এসেছেন। উপজেলার বানেশ্বরদী, নকলা, গনপদ্দী, চন্দ্রকোনা ও উরফা ইউনিয়নের কৃষকরা জানান, চলতি বোরো আবাদে তাদের লাভ না হয়ে ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্য এলাকার অনেক কৃষক জানান, যারা নিজে শ্রম দিতে পারছেন তাদের হয়ত আসল থাকবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, এবছর নকলা উপজেলায় লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৪৫ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে এবং ফলন ভালো হয়েছে। তবে দামটা কিছু কম এবং শ্রমিক মজুরি বেশি হওয়ায় কৃষকরা অপেক্ষাকৃত কম লাভ পাবেন। তিনি বলেন, একসাথে ধান কাটা শুরু হওয়ায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে, ফলে মজুরি বেশি লাগছে; অন্যদিকে সকল কৃষক শ্রমিকের মজুরি মূল্য মিটাতে ধান বিক্রি করায় দামের দরপতন ঘটেছে। তবে কিছু দিনের মধ্যেই ধানের দাম বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করছেন।