Site icon

দেশে ৪০ মিলিয়ন লোক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এজন্য কৃষি গবেষণা জোরদার করতে হবে – একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম

বাকৃবি থেকে মো. আউয়াল মিয়াঃ

৪০ মিলিয়ন লোক পুষ্টিহীনতায়
বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষক, গবেষক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম। গবেষণাই তার নেশা ও পেশা বলা চলে। ১৯৯১ সালে থেকে এখন পর্যন্ত গবেষণা করেই চলেছেন তিনি। বাউকুল, আম, পেয়ারা, লেবু,জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, জলপাই, আমলকি,ডুমুর, মালটা, অরবরই, লটকন, স্ট্রেবেরী, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, রামবুটান, কাজুবাদাম, ড্রাগন, লিচু, তেতুঁল, লংগান, সফেদারসহ এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ফলসহ মোট ৮১ প্রজাতি উদ্ভাবন করেছেন। একাধারে তিনি বাউ- জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও প্রধান রুপকার। তিনি দেশী ও বিদেশী পুরষ্কারে ভূষিত হন।
বাংলাদেশের ফল উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার । সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মো. আউয়াল মিয়া।
আউয়াল মিয়াঃ আপনার গবেষণার বিষয় ও এর সাথে আর কে কে জড়িত?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ বিদেশী ফলের আগ্রাসনে ও উদ্ভাবিত নতুন জাতের প্লাবনে আমাদের দেশী ফলগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে, দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই আমাদের গবেষণার বিষয়। বাউ- জার্মপ্লাজম সেন্টার বা ফল জাদুঘর, বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইস এজেন্সী ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো- অপারেশন অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন-এগ্রো ফরেস্ট্রি ইমপ্রুভমেন্ট পার্টনারশিপ এর ব্যবস্থাপনায় এ ফল জাদুঘরটি গোড়াপত্তন হয় ১৯৯১ সালে। তখন প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ফ্রুট ট্টি স্টাডিজ, পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়, ফল উন্নয়ন প্রকল্প, এখন এটাকে ফলদ বৃক্ষের “ জার্মপ্লাজম সেন্টার” বলা হয়। বর্তমানে এ সেন্টারটি বাংলাদেশে তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা। বর্তমানে এ প্রকল্পটির অর্থায়ন করছে সুইস এজেন্সী ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো- অপারেশন অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন এএফআইপি। ১৯৯১ সনে প্রকল্প মাত্র এক একর তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মমুখর হয়ে উঠে, যার ফলাফল ক্রমেই ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। বর্তমানে এর আয়তন ৩২ একর। গবেষণার সাথে অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হোসেন, ড. মো. শামসুল আলম মিঠু, পিএইচডি ও মার্স্টাসের ছাত্র-ছাত্ররী জড়িত।
আউয়াল মিয়াঃগবেষণা কত বছর মেয়াদী প্রকল্প? আর কোন কোন স্পটে গবেষণাটি করেছেন?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যবধি গবেষণা চলছে। এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই আমাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছি।

আউয়াল মিয়াঃআপনি কোন উপলব্ধি থেকে আসলে গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং এর এখন কি অবস্থা?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ ফলের বীজ ব্যাংক তৈরি, দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা এবং দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করতেই গবেষণা শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ৮১ টি জাত উদ্ভাবন করেছি। খরা, তাপ, বন্যা ও লবণ সহিষ্ণুজাত উদ্ভাবনের চেষ্টায় রয়েছি। আশা করি সফল হব।

আউয়াল মিয়াঃ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার গবেষণায় কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ  আমি মনে করি এখন পর্যন্ত সফল। আমরা যে জাতগুলো উদ্ভাবন করেছি তা মাঠ পর্যায়ে খুব ভাল ফলাফল দিচ্ছে। আমরা অর্গানিক ফল ও শাকসবজির প্রতি অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই সাখে স্বল্প সময়ে ও স্বল্পব্যয়ে কীভাবে ফল ও শাক সবজি উৎপাদন করা যায় সেই দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছি। বাউকুল বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেক অবদান রাখছে। বিশ্বের ২৭ টি দেশে বাউকুল চাষ করা হচ্ছে।

আউয়াল মিয়াঃএখন পর্যন্ত আপনার গবেষণায় কি কি ফলাফল এসেছে?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ বাউকুল, আম, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, জলপাই, আমলকি,ডুমুর, মালটা, অরবরই, লটকন, স্ট্রেবেরী, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, রামবুটান, কাজুবাদাম, ড্রাগন, লিচু, তেতুঁল, লংগান, সফেদারসহ এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ফলসহ মোট ৮১ প্রজাতি উদ্ভাবন করেছি। বিভিন্ন বিদেশি ফল প্যাসন ফল, জাবাটিকাবা, শানতোল, রাম্বুটান, লংগান, ম্যাঙ্গোস্টিন, সীডলেস লিচু, ডুরিয়ান, এভোকেডো ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা কওে ভবিষ্যতে এ দেশে নতুন জাত হিসেবে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় আছি। বর্তমানে এখানে ৪৯টি দেশের প্রায় ৫৮টি ফল ও ফল গাছের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে। এছাড়াও আলু,কলা, কচু ও গাজর নিয়ে কাজ করছি। আশা করি সফল হব।
আউয়াল মিয়াঃ আপনার এই গবেষণা কিভাবে এদেশের মানুষের উপকারে আসতে পারে একটু যদি ব্যাখ্যা করতেন?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়, গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থান, মাঠ পর্যায়ে ফলাফল ভাল, আয়ের উৎস বাড়ানোসহ গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশীয় প্রধান ও অপ্রধান ফলগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের ফল আমদানি কম করতে হচ্ছে।
আউয়াল মিয়াঃশুরু থেকে এখন পর্যন্ত গবেষণাটির প্রক্রিয়া কিভাবে চলছে?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দেশের প্রচলিত ও বিলুপ্ত প্রায় ফলের গাছ সংগ্রহ করে স্বল্প সময়ে কম ব্যয়ে বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যে আমরা শুরু থেকে কাজ করছি। দেশীয় আবহাওয়া উপযোগী ও অর্থনৈতিক লাভজনক করাই আমাদের উদ্দেশ্য।

আউয়াল মিয়াঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গবেষণাগুলোর গুরুত্ব কি রকম?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ আমাদের দেশের মানুষ শুধু পেট ভরে ভাতই খায়। তারা সুষম খাবার বোঝে না। প্রতিদিন মানুষের ১২০ গ্রাম ফলমূল ও ২০০ গ্রাম সবজি খাওয়া দরকার। এদেশে এখনো ৪০ মিলিয়ন লোক নীরব দুর্ভিক্ষে (পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা) ভুগছে। আমরা এই সমস্যাগুলো কমানোর চেষ্টায় আছি। সেই সাথে বাংলাদেশ যাতে ধানের পাশাপাশি ফলমূল ও শাকসবজিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

আউয়াল মিয়াঃ  সরকারের প্রতি কোন পরামর্শ আছে কিনা?
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ বৃক্ষ মানবের পরম বন্ধু। শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রতিনিয়ত আমরা এই পরম বন্ধুকে হারিয়ে ফেলছি। মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ আমাদের জীবনধারনের প্রয়োজনীয় অক্্িরজেন সরবরাহের পাশাপাশি ফলদিয়ে আমাদের পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। আমাদের এই পরম বন্ধুকে আগলে রাখতেই
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ফলজ গাছের সমৃদ্ধ বাউ- জার্মপ্লাজম সেন্টার বা ফল জাদুঘর। শুরু থেকেই দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত নানা ফলদ বৃক্ষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং বিদেশি ফলের ওপর গবেষণা চালিয়ে এদেশে উৎপাদন উপযোগী জাত উদ্ভাবনের নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছি।
চাহিদার তুলনায় আমাদের দেশে গবেষণা একবারেই অপ্রতুল। আরো গবেষণা ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। যাতে অধিক জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করা যায়। আমাদের উদ্ভাবিত জাতগুলো যাতে প্রান্তিক কৃষকের হাতে পৌঁছাতে পারে সেই ব্যাপারে সরকারের সহযোগীতা কামনা করছি। সেই সাথে গবেষণার জন্য অধিক বাজেট বরাদ্দ ও বৃদ্ধি করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছি।

আউয়াল মিয়াঃআপনাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেনঃ           মোঃআউয়াল মিয়া

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিমঃ আপনাকেও ধন্যবাদ

Exit mobile version