শেরপুরের নকলায় সম্ভাবনাময় ফল মাল্টা চাষে সফল

সম্ভাবনাময় ফল মাল্টা

সম্ভাবনাময় ফল মাল্টা

মো. মোশারফ হোসাইন, শেরপুর প্রতিনিধি:

সম্ভাবনাময় ফল মাল্টা ঃ বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। এরমধ্যে মাল্টার চাষ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শেরপুরের নকলা উপজেলায় ধান চাষের উপযোগী সমতল জমিতে গভীর সম্ভাবনাময় ফল মাল্টার চাষ করে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন উপজেলার টালকী ইউনিয়নের ফুলপুর এলাকার আলহাজ্ব আব্দুর রহমানের ছেলে মো. অনোয়ার হোসেন। প্রতিদিন মাল্টা বাগান পরিচর্যার মধ্য দিয়ে আনোয়ারের সারা দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। এ বাগানকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তিনি ইতোমধ্যে এক একর জমিতে পুকুর খনন করার জন্য জমি নির্বাচন করেছেন। ওই পুকুরে মাছ এবং পাড়ে মাল্টা লাগানোর জন্য বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ও অধিক উৎপাদনশীল মাল্টা গাছের চারা পেতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন।
আনোয়ার হোসেন রাজধানী ঢাকায় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এবং বেতন ভাতাও পেতেন ভালো। কিন্তু পরিবারিক প্রয়োজনে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে এসে মাল্টার বাগান করার পরিকল্পনা করেন। শুরুতে লোকসানের ভয়ে বিষয়টিকে পরিবারের কেউই ভালোভাবে না নিলেও, এখন তার সফলতা দেখে সবাই তাকে সহযোগিতা করছেন। ২০১৭ সালে ১০ শতক জমিতে ৫০টি গাছ দিয়ে তিনি মাল্টার বাগান শুরু করেন। ওই বছরই প্রতিটি গাছে ৫-৭ টি করে মাল্টা ধরে। এর পর মাত্র ৩ বছরেই তিনি আজ সফল মাল্টা চাষির পরিচিতি পেয়েছেন।
আনোয়ারের বাগানের আশেপাশের বাতাসে যেন টক-মিষ্টির গন্ধ। গাছের পাতার চেয়ে মাল্টা বেশি ধরেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে মাল্টা। কম্পোস্ট, কেঁচো বা ভার্মিকম্পোস্ট, খৈল ও গোবরসহ বিভিন্ন জৈবসার ব্যবহারে প্রাকৃতিক বেড়ে ওঠা বাগানের ওই সব গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে ছোট বড় হাজারো মাল্টা। ফলের ভারে পুরো বাগানের গাছগুলো যেন নুয়ে পড়েছে। এ দৃশ্য ও আনোয়ারের সফলতা দেখে যেকেউ বিমোহিত হবেন। কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন তার বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন।
গাছে থোকায় থোকায় মাল্টা ধরায় এ অঞ্চলে মাল্টা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও চাষিরা। মাটির গুনাগুন বিবেচনায় বৃহত্তর সিলেট, চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলায় চাষ উপযোগি হলেও সমতল অঞ্চলে মাল্টা ও কমলালেবুর মতো বিদেশি ফলের ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। আজ তা প্রমান হতে চলেছে বলে জানান কৃষি অফিসার ও আনোয়ারের মতো অনেক মাল্টা চাষী। অধিক ফলন ও লাভ বেশি হওয়ায় এলাকার অনেকে অন্যান্য আবাদ ছেড়ে মাল্টা চাষের দিকে ঝুঁছেন। শখেরবসে বাড়ির আঙ্গীনায় ২-৪ টি করে মাল্টা গাছ রোপন করে সুফল পাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বানিজ্যিক ভাবে মাল্টা বাগান করার লক্ষ্যে ধানের আবাদি জমি নির্বাচন করে বাগান করার কাজ শুরু করেছেন।
আনোয়ার হোসেন জানান, ২০১৬ সালের শুরুতে একটি প্রিন্ট পত্রিকা ও একটি বেসরকারি টেলিভিশনে মাল্টা চাষে সাবলম্বী হওয়ার একটি প্রতিবেদন দেখে তিনি এই বিদেশি ফল চাষে আগ্রহী হন। ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে এসে, ২০১৭ সালের শুরুতে মাল্টার বাগান করেন। এর পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বারি মাল্টা-২ জাতের ৫০ টি চারা সংগ্রহ করে মাল্টা চাষ শুরু করেন। চারা লাগানোর কয়েক মাস যেতে না যেতেই তার বাগানের গাছে মুকুল আসতে শুরু করে। ওই বছর ২০১৭ সালে বেশকিছু ফল টিকে। এসব মাল্টা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনরা খেয়ে দেখেন, আনোয়ারের বাগানের মাল্টা গুলো রসালো ও বেশ সুস্বাদু। এদেখে তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আনোয়ারের বাবা আব্দুর রহমান জানান, বিদেশি মাল্টার চেয়ে তার ছেলের বাগানের মাল্টা বড়, রসালো, বেশ সুস্বাদু ও নিরাপদ। তাই এ বাগানের অধিকাংশ মাল্টা বিভিন্ন এলাকার রোগীরা পথ্য হিসেবে খেয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুস্বাদু হওয়ায় আনোয়ারের বাগানের মাল্টার চাহিদা খুব বেশি। দূরের বিভিন্ন এলাকার রোগীর জন্য এই বাগান থেকে নিরাপদ মাল্টা কিনে নিয়ে যান। ২০১৮ সালে তার বাগানের প্রতিটি গাছে ১৫ থেকে ২৫ কেজি করে মাল্টা ধরে। ওই বছর নিজেরা খাওয়ার পরে অবশিষ্ট মাল্টা স্থানীয় বাজারে ১০০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। ২০১৯ সালে প্রতিটি গাছে ২০ কেজি থেকে ৪০ কেজি করে ফলন হয়। এসব মাল্টা স্থানীয় পাইকাররা বেশি দামে কিনে নিলেও, প্রচুর চাহিদা থাকায় পাইকারদের লাভ বেশি হয়।
স্থানীয় ফল ব্যবসায়ীরা জানায়, আনোয়ার হোসেনের বাগানের মাল্টা আকারে বড়, রসালো, খেতে সুস্বাদু ও নিরাপদ হওয়ায় স্থানীয় বাজারগুলোতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে আনোয়ারের যেমন বাজার জাতের কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না, তেমনি স্থাানীয় ফল ব্যবসায়ীদের বিক্রি বেড়েছে। তার বাগানের মাল্টা গুলো কাঁচা অবস্থায় গাড় সবুজ এবং পাকলে হালকা হলুদ রং ধারণ করে। প্রতিটি মাল্টার ওজন গড়ে ১৫০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম হয়ে থাকে। তারা আরও বলেন, বিদেশি মাল্টা দেশের বাজার দখল করে রাখলেও, পিছিয়ে নেই আনোয়ারের ক্ষেতে উৎপাদিত এ মাল্টার মতো দেশে উৎপাদিত মাল্টা।
এ বিষয়ে মাল্টা চাষী আনোয়ার হোসেন বলেন, মাল্টা বছরে একবার ফলন হওয়ার কথা শোনা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে আমার বাগানে সারা বছরই মাল্টা ধরে আসছে। এতে করে দামও পাচ্ছি ভালো। প্রতিটি গাছের এক ডালে বড় বড় মাল্টা ঝুলছে, আবার কিছু কিছু পাকতেও শুরু করেছে। অন্য ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে ছোট ছোট মাল্টা এবং নতুন কিছু ডালে মুকুল আসছে। আমার বাগানে প্রথম বছর তেমন বেশি ফলন না আসলেও, পরবর্তী বছর থেকে ব্যাপক ফল পাচ্ছি। স্থানীয় লোকজনের কাছে ও বাজারে আমার বাগানের মাল্টার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। অন্য যেকোন ফলের চেয়ে মাল্টা চাষে লাভ বেশি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমার বাগানে উৎপাদিত মাল্টা বাঁশাটী, নকলা ও ফুলপুরের মতো স্থানীয় বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করি। আমি মাল্টা চাষ করে এখন সফলার মুখ দেখতে শুরু করেছি, বলা চলে আমি এখন স্বাবলম্বী হওয়ার সিড়িতে আিছ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বানিজ্যিক ভাবে মাল্টা চাষ করলে, যে কেউ সাবলম্বী হবেন, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই বলে দাবী এই চাষীর।
অতিরিক্ত উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রোকসানা নাসরীন বলেন, দেশে বারি মাল্টা-১ (পয়সা মাল্টা), বারি মাল্টা-২, থাইল্যান্ডের বেড়িকাটা মাল্টা ও ভারতীয় প্রলিত মাল্টা জাতের চাষ করা সম্ভব। তবে নকলায় চাষ করা অধিকাংশ মাল্টা বারি-২ জাতের। তিনি মাল্টা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানান, সমতলে ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ত করে ৪-৫ মিটার দূরত্বে বৈশাখ মাসে চারা বা কলম কাটা চারা লাগাতে হয়। প্রতি গর্তের মাটির সঙ্গে ১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, সমপরিমান এমওপি ও চুন, ৩ থেকে ৫ কেজি ছাই মিশিয়ে ভরাট করে মাদা তৈরীর করে, ১০ থেকে ১৫ দিন পরে চারা বা কলম কাটা চারা লাগাতে হয়। এরপর হালাকা সেচ দিতে হয়। আগাছা দমনসহ বর্ষকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। চারা অবস্থায় মাল্টা গাছের গোড়া থেকে গজানো অতিরিক্ত কুশি বা মাথা এবং মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল মাঝে মাঝে ছেটে রাখতে হয়।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, মাল্টা একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। দোআঁশ মাটি মাল্টা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। নকলার মাটি ও আবহাওয়া মাল্টা চাষের উপযোগী। আনোয়ার হোসেন মাল্টার বাগান করে সুফল পেয়ছেন, লাভবান হয়েছেন। কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, আনোয়ার হোসেনের মাল্টার বাগান দেখে অন্য কৃষকরা মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন। ফলন ভালো হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের অন্য জেলায় পাঠানো সম্ভব। দেশে সম্ভাবনাময় ফল মাল্টা বাড়াতে পারেল কমবে বেকারত্ব, বাড়বে কর্মসংস্থান ও কৃষি আয়, সমৃদ্ধ হবে কৃষি অর্থনীতি; এমনটাই আশাব্যক্ত করেন তিনি।

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *