রাজশাহীতে দেশের দ্বিতীয় দানাদার শস্য গমের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

গমের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

গম ক্ষেতের ছবি
কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি বিলের চারদিকজুড়ে যেন সবুজের সমারোহ। সবুজ গমের গাছগুলোর সবুজ শীষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর হাওয়া এলে সেগুলো দুলছে। গমের এই নাচনের তালে তালে যেন কৃষকেরও মন নাচ্ছে আনন্দে। রাজশাহীর মধ্যে গোদাগাড়ীতে সবচেয়ে বেশি গমের চাষ হয়েছে এবার। ফলনও বাম্পার হবে বলে এবার গমই যেন কৃষকদের সোনালী ফসলে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে। শুধু গোদাগাড়ীতেই নয়, রাজশাহীর আরো ৮টি উপজেলাতেই এবার গমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
তাদের দাবি, রাজশাহীতে এবার অনুকূল আবহাওয়াসহ সবকিছুই ছিল গমচাষ উপযোগী। আবার ধানের চেয়ে সেচ ও খরচ দুটিই কম প্রয়োজন হওয়ায় গমচাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। এতে করে এ ফষল চাষে আগ্রহী হয়েও উঠছেন তাঁরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, জেলাতে ২০০০ সালের পর থেকেই মূলত গম চাষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত ১৬ বছরে সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে অন্তত ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন হচ্ছে। এই বছরেও রাজশাহীতে গমচাষ হয়েছে ৩১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে ৩৫০ হেক্টর কম। গত বছর ছিল ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে। এর আগের বার ২০১৪ সালে প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতের। তার আগে ২০১৩ সালে রাজশাহীতে গম চাষ হয় ৩২ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে। হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে। এর আগে ২০১১ রাজশাহীতে গমচাষ হয়েছিল ২৭ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম জানান, রাজশাহীতে গত বছর ৯১ হাজার ৬২৬ মেট্রিক টন গম উৎপাদন হয়েছে। সেই হিসেবে এবারো অন্তত ৯১ হাজার মেট্রিক টন গমের উৎপাদন হবে। প্রতি হেক্টরে (৯ বিঘায় এক হেক্টর) এবার গমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বিঘা প্রতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে অন্তত ১০ মণ হারে।
জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান জানান, এ উপজেলায় এবার সবচেয়ে গমচাষ বেশি হয়েছে। এবার এখানে গমচাষ হয়েছে ৮ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে। যা অতিতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর আগে কখনোই এতো পরিমাণ গমচাষ হয়নি এ উপজেলায়। এবার গমের ফলনও বাম্পার হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
উপজেলার প্রেমতলি এলাকার গমচাষি মকবুল হোসেন বলেন, এবার তিনি প্রায় ৫ বিঘা জমিতে গমচাষ করেছেন। অন্যান্যবার টমেটো অথবা ধানচাষ করতেন অধিকাংশ জমিতে। কিন্তু এবার গমই বেশি করেছেন। আবার ফলন ভালো হবে এ আশায় লাভের স্বপ্নও দেখছেন তিনি।
জেলার দুর্গাপুরে এবার গমচাষ হয়েছে ২ হাজার হেক্টর জমিতে। এ উপজেলার চাষি আনছার আলী বলেন, গমচাষে তেমন খরচ হয় না। বিঘা প্রতি সবমিলিয়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হয় সর্বোচ্চ। তবে ১০ মণ গম পেলেও অন্তত ৩ হাজার টাতা লাভ হবে। আবার জ্বালানিও পাওয়া যায় গমের ডাটা থেকে। সেগুলোও বিক্রি করা যায়।
জেলার বাঘায় আগে সবচেয়ে বেশি গমচাষ হতো। তবে এবার বাঘাকে পেছনে ফেলে গোদাগাড়ীতে হয়েছে বেশি। তারপরেও বাঘায় এবারো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গমচাষ হয়েছে। এ বছর এ উপজেলাতে ৫ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে চরাঞ্চলেই হয়েছে বেশি পরিমাণ গমচাষ।
উপজেলার গড়গড়ি এলাকার কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, গমচাষে পানির পরিমাণ কম লাগে। আবার সার-বিষও তেমন দিতে হয় না। ফলে র্অপ পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। এতে কৃষকরা গমচাষে ঝুঁকছেন বেশি।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে সুষ্কমৌসুমে তীব্র পানি সঙ্কট দেখা যায়। এতে করে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করতে কৃষকদের হুমকির মধ্যে পড়তেহয়। বিশেষ করে ধানচাষ করতে গিয়ে কৃষকদের দুর্ভোগের শিকার হতে হয় বেশি। পানির অভাবে কোনো কোনো কৃষকের জমিতে ধানগাছ মরেও যায়। কিন্তু গমচাষে অতটা পানির প্রয়োজন হয় না। ফলে পানির সঙ্কটও থাকে না এ ফসল চাষ করতে গিয়ে।
রাজশাহীতে গমচাষ শুরু হয় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মার্চের মাঝামাঝি থেকে গম কাটা শুরু হয়। যা চলে প্রায় গোটা মাস। সেই হিসেবে রাজশাহীতে এখনো গম কাটা শুরু হয়নি। অধিকাংশ জমিতে গমের শীষগুলো এখনো সবুজ হয়ে আছে। কয়েকদিন পর থেকে হয়তো সেগুলোতে লাল রং দেখা দিয়ে পাকতে শুরু করবে।

এদিকে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারনে ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার বিঘা জমির গমের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই প্রথম ব্লাষ্ট নামক রোগটি মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলাতে মহামারী আকার ধারন করেছে। গম পরিপরিপক্কতার সময় এ রোগের কারনে গম চাষীরা কোন প্রকার প্রতিকার না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পডেছে। প্রথমে গমের পাতা হলুদ ও লাল হয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে গমের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন। নওয়াপাড়া গ্রামের গম চাষী জাবের আলী জানিয়েছেন যে,সকল জমিতে তামাকের চাষ করা হয়েছিল এমন জমিতে প্রথমে এ রোগটি দেখা দেয় পরে এর আশপাশের জমিগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং যে সকল জমি তামাকের জমি থেকে ্টু দুরে সে সকল জমিতে একটু দেরীতে এ রোগটি দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এ রোগটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। কৃষক হায়দার আলী জানান, আমার একটি জমিতে গত বছর তামাক চাষ করা হয়েছিল সে তামাকের জমিতে পোঁড়া মুলা বের হয়। এ বছর উক্ত জমিতে গমের চাষ করেছিলাম হঠাৎ জমিতে গিয়ে দেখি সব গমের শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে জমি থেকে গম কেটে গোঁ খাদ্য হিসাবে ব্যাবহার করা হছ্ছে। এ বছর ১ কেজি গম ঘরে তুলতে পারবনা। কৃষক আঃ রহমান জানান,যে সময় গম কাটা মাড়াইয়ের সময়, ঠিক সেই সময় এ ব্লাষ্ট নামক রোগটি’র কবলে পড়েছি আমরা।আমাদের জেলাতে আমার মত হাজারও কৃষক তাদের জমির গমের শীষ শুকিয়ে যাওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মেহেরপুর জেলাতে গত বছর ১৭ হাজার ৪১৩ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছিল যার উৎপাদন ছিল ৭ হাজার ৯১১ মেট্্িরক টন। চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৬ হাজার ৩৭৫ হেক্টর,গাংনী উপজেলায় ৬ হাজার হেক্টর,ও মুজিবনগর ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। তবে বারিগম-২৬ এর ক্ষেত্রে এ রোগের পাদুর্ভাব বেশী লক্ষ্য করা গেছে। গম গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রথমে রোগের নাম করণ করা হয়েছিল হেড ব্লাইন্ড’ পরে নাম করণ করা হয়েছে ব্লাষ্ট। রোগটির নামকরণ করতেই শত শত বিঘা জমির গম শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ থেকে এ রোগের প্রতিকার হিসাবে যে ওষুধ ব্যাবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাকে কৃষকরা কোন ভাবেই উপকৃত হচ্ছেনা বলে জানালেন স্থানীয় কৃষকরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি অফিসার মুস্তাফিজুর রহমান জানান, বাংলাদেশে এই প্রথম এ ব্লাষ্ট নামক রোগটি মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলাতে মহামারী আকার ধারণ করেছে। সে মোতাবেক আমরা কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে কৃষকরা কিছুটা হলেও উপকার পাচ্ছে। তবে হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে এ রোগটি দেখা গেছে।

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *