মানবদেহেরপুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাছ

মাছের ভূমিকা

মাছের ভূমিকা

মোঃ ইউসুফ আলী ও মোঃ আব্দুস সালাম

মাছের ভূমিকা ঃ মাছে ভাতে বাঙালি আমরা। প্রাচীনকাল থেকেই মাছ আমাদের স্বাদ ও সাধের এক খাবার বললে অত্যুক্তি হবে না। তাই বাংলাদেশ সরকার সর্বদায় মৎস্য খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে। গুরুত্বের সেই ফলস্বরূপ বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপি’র প্রায় এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৫.৭১%) মৎস্য খাতের অবদান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে ৩য় এবং চাষের মাছ উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।

মাছের দেহে পুষ্টিমান

মাছ একটি উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ দামে সস্তা ও সহজ পাচ্য, কম চর্বি ও শ্বেতসার (কার্বোহাইড্রেট) যুক্ত নিরাপদ খাদ্য। মানুষের দেহের জন্য একটি সুষম খাদ্যের উপাদানগুলো হলো- প্রোটিন (আমিষ), কার্বহাইড্রেট (শ্বেতসার), লিপিড (স্নেহ), ভিটামিন (খাদ্য প্রাণ), খনিজ লবণ ও পানি। পুষ্টিগত দিক থেকে মাছে উপরোক্ত সবগুলো উপাদানই বিদ্যমান। মাছে সাধারণত জলীয় অংশ ৬৫-৮০%, আমিষ ১৫-৩০%, ফ্যাট ৫-২০% এবং ভিটামিন/মিনারেলসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান ০.৫-৩% পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। মাছে খাদ্য উপাদানগুলো একটি সুষম মানে বিদ্যমান রয়েছে। মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণের ফলে শরীরের গঠন-বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, পুষ্টি সাধন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে এবং গ্রহণের ফলে দ্রুততম সময়ে হজম হয়ে মানবদেহে শক্তি উৎপন্ন হয়।

উচ্চ আমিষের উৎস

প্রাণিজ আমিষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস হওয়ায় মাছকে অনেক বিজ্ঞানী সুপার আমিষ বলে অভিহিত করেছেন। আমিষ প্রাণিদেহের দেহের গঠন, বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধের প্রধান উপাদান। আমিষ অ্যামিনো এসিড নামক ক্ষুদ্র উপাদান দিয়ে গঠিত। ২০ ধরণের অ্যামিনো এসিডের মধ্যে মানুষের দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ১০ প্রকার অ্যামাইনো এসিড (লাইসিন, আরজিনিন, হিস্টিডিন, লিউসিন, আইসোলিউসিন, ভ্যালিন, থ্রিওনিন, মিথিওনিন, ফিনাইল অ্যালানিন ও টাইরোসিন) রয়েছে যার প্রত্যেকটিই মাছে বিদ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, আমাদের প্রয়োজনীয় আমিষের ৬০% পাই মৎস্য থেকে। খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) মতে (২০১৯), বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ১৯৯০ সালে ছিল বছরে সাড়ে ৭ কেজি, এখন তা প্রায় ৩০ কেজি। মাছে প্রজাতি ভেদে ১৫-৩০% আমিষ বিদ্যমান থাকে। তাছাড়া শুটকি ও কিছু শুকনো মৎস্য জাত পণ্যে আমিষের পরিমাণ ৩৫-৫৫%।

উপকারি তেল

মানবদেহে সাধারণত তিন ধরণের চর্বি পাওয়া যায় এর মধ্যে অন্যতম হলো পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড । যেটি মানব দেহের জন্য উপকারী ও অত্যন্ত দরকারি অথচ দেহের ভেতরে তৈরি হয় না। বাইরের উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করলে এটি মানুষের শরীরের তৈরি হয়। মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ তেল রয়েছে যা করোনারি হৃদরোগ, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী একটি ব্যাপক আলোচিত উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন মাছ খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের আশংকা অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া লোনা পানির মাছ দৈনিক ১ আউন্স (২৮.৩৫ গ্রাম) পরিমাণ খেলে হৃদরোগের আশংকা ৫০% কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে রয়েছে দুইটি অত্যাবশ্যকীয় পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ইকোসা পেন্টানোয়িক এসিড (ঊচঅ) ও ডোকোসা হ্যাক্সানোয়িক এসিড (উঐঅ) যেগুলি কেবল সামুদ্রিক মাছ ও ফাইটোপ্লাংকটনে সাধারণত দেখা যায়। এগুলোর অভাবে মানুষের মস্তিকের স্বাভাবিক বিকাশে মারাত্মকভাবে ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়াও ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন (এ, ডি, ই ও কে) বহনে এইসব উপাদান অত্যন্ত জরুরী যা অভাব দেখা দিলে দেহে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত সামুদ্রিক মাছগুলোতে ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, স্যামন, টুনা, ম্যাকারেল, কড, ইলিশ জাতীয় মাছের অত্যাধিক পরিমাণ ওমেগা-৩ বিদ্যমান।

ভিটামিনের উৎস

খাদ্য হিসেবে মাছের অন্যতম গুণ হলো এতে বিদ্যমান ভিটামিনের জন্য। রোগীর পথ্য হিসেবে মাছ বিশেষ সমাদৃত। ভিটামিনের প্রধান কাজ হলো জীবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মাছে বিদ্যমান ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন- এ, বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৬, বি-১২, ডি ও ই। এই উপাদানগুলো তৈলাক্ত ও সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়িতে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে।

ছোট মাছে বিশেষ করে মলা, ঢেলা, দারকিনা, কাচকি, পুঁটি, খলসে প্রভৃতি মাছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ থাকে। এই ভিটামিনের অভাবে মানুষের রাতকানা রোগ হয়। মাছের যকৃত ও তেলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ থাকে যা হাড়, দাঁত, চর্ম ও চোখের জন্য প্রয়োজন। মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-২, বি-৩, বি-৬ ও বি-১২ রয়েছে যা চর্ম ও স্নায়ুবিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কতিপয় মাছ ও চিংড়িতে ভিটামিন ‘ই’ বিদ্যমান। সদ্য ধরা মাছের চামড়াতে ভিটামিন ‘সি’ পেয়েছেন গবেষকরা।

মিনারেলের উৎস হিসেবে মাছ অনন্য

সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল বিদ্যমান। যা মানবদেহের ভারসাম্য রক্ষা ও হাড় গঠনে অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপাদান। মাছে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, লৌহ, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ফ্লোরিন ইত্যাদি। মাছের কাঁটায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস থাকে যা আমাদের হাড়, ব্রেইন ও দাঁত গঠনে সহায়তা করে। সামুদ্রিক মাছের আয়োডিন, জিংক, লৌহ, ক্যালসিয়াম রয়েছে যা গয়টার, ত্বক ও স্নায়ুতন্ত্রের উন্নয়ন, অ্যানিমিয়া, মস্তিষ্কের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দেশের ৭০% মা ও শিশু রক্ত শূন্যতায় ভোগে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আয়রন। শিং, মাগুর ও কৈ ইত্যাদি মাছ আয়রনের অভাব পূরণের জন্য রোগী, মা ও শিশুর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে। শিশুর জন্য মায়ের দুধের পরেই ছোট মাছের স্থান।

রাতকানা, রক্তশূণ্যতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ জটিল সব রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের নিরাপদ উৎস হিসেবে মাছ রাখা উচিত। বিশেষ করে ছোট, তৈলাক্ত ও সামুদ্রিক মাছ পরিবারের সবাইকে খেতে অভ্যস্ত করে তোলা দরকার। এতে আমাদের পরিবারের সদস্যরা অনেক ধরণের রোগ-বালাই হতে রক্ষা পাবে। চলমান করোনা’র দুর্যোগকালে বেশি বেশি মাছ খান, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান।

লেখকঃ
মোঃ ইউসুফ আলী
উপসহকারী পরিচালক (৩৭তম বিসিএস)
মৎস্য অধিদপ্তর, বাগেরহাট

মোঃ আব্দুস সালাম
পরিসংখ্যান কর্মকর্তা (৩৪ তম বিসিএস)
সামুদ্রিক মৎস্য অফিস, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *