কোনও আতঙ্ক নয়, মৌসুমী আম খান প্রাণ ভরে

ডায়াবেটিস রুখতে আম

মৌসুমী আম খান

মো:বশিরুল ইসলাম 
মৌসুমী আম খান ঃ বাঙালির রসনা তৃপ্তির মাস জৈষ্ঠ্য । যেটি বাঙালীর কাছে পরিচিত মধুমাস হিসেবে। এ সময় ধনী থেকে গরীব সব শ্রেণি মানুষের মধ্যে দেখা যায় ফল কিনা  উৎসব। দামও থাকে সাধ‍্যের মধ্যে। ফলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে ক্ষুদ্র থেকে বড় ফল ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। এর পরই বাজারে আসবে গোপালভোগ, লক্ষণ ভোগ, হিমসাগর বা খিরসাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, বারি আম-২, ফজলি, বারি আম-৩, বারি আম-৪ এবং আশ্বিনা আম দিয়ে মৌসুম শেষ হবে।
স্বাদে-গুণে ভরা নানান ফলের বৈচিত্র্যে আম হলো ফলের রাজা। আমের ভাল গুণাগুণের সঙ্গে যোগ হয়েছে অপপ্রচারও। কোথাও যেন স্বস্তি নেই।আমরা সাধারণ ক্রেতা যখন বাজারে ফল কিনতে যায়, তখন আমাদের মনে খটকা লাগে। সন্দেহ জাগে, এগুলো খাঁটি আম তো? মানে ফরমালিন, ক‍্যালসিয়াম কার্বাইড রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো হয়েছে কি না? এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। আসলে আমের মৌসুম শুরু হলেই এ প্রশ্নগুলো চলে আসে। একবার ভাবুনতো সারা বছর বিদ‍েশ থেকে এত আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি,  প্যসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট,  আংগুর, খেজুর ইত্যাদি মাসের পর মাস পচে না। তারা কোন কিছুই দেয় না? আর আমাদের দেশের আম চাষীদের আম কিনতে গেলে সব বিষে ভরা! আমি মনে করি, এতে দেশীয় আম চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর দেশীয় এ ফলের বাজার চলে যাচ্ছে বিদেশী ফল আমদানিকারকদের হাতে। আমাদের যে ধারণা দেশি ফল-মূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা৷ 
জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন বিরোধী  ২০১৪ সালে অভিযানের কথা অনেকেই হয়তো ভোলেননি৷ গ্রীষ্মকালীন ফলের ভরা মৌসুম, তখন ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান চালানো হয়। আমে বিষাক্ত ফরমালিনসহ নানা রকম রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগ এনে ঢাকা শহরের সবগুলো প্রবেশমুখে ব্যাপক তল্লাশি করে ট্রাক ট্রাক আম ধ্বংস করা হয়। পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হয়েছিল তা বাতাসে ফরমালডিহাইড মাপারযন্ত্র। পরবর্তীতে তিনটি সংস্থার পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সেই যন্ত্রটিকে অকার্যকর ঘোষণা দেয়। এ আতঙ্ক এখনো বিরাজমান বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি দেশবাসীর এই সন্দেহ দূর করতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এ সংস্থাটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলছে, ফলে ফরমালিন মেশালে তা সংরক্ষণে কোনও ভূমিকা রাখে না। এর পক্ষে স্বীকৃত সংস্থাগুলোর গবেষণা ও দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের অভিমত সামনে এনেছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
আমার প্রশ্ন হলো যে দেশের এখনও এক তৃতীয়াংশ লোক অপুষ্টিতে ভোগে সেখানে কোন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কয়েক হাজার মন আম ধ্বংস করা কতটুকু যৌক্তিক? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মতে, প্রতিদিন আমাদের ফল এবং সবজি খাওয়া দরকার ৪০০ গ্রাম সেখানে আমরা খাই মাত্র ২৪৮ গ্রাম। যেখানে আমরা এমনিতেই কম পরিমাণে খাই সেখানে কেমিক্যালের ভয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিলে এর ঘাটতি থেকেই যাবে। ধ্বংস করা আগে এর ক্ষতিকর এবং উপকারের মাত্রা হিসাব নিকাশ করে তারপর  ধ্বংস করা উচিত। 
আমের ফরমালিন ব‍্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের সাথে আমার কথা হয়। তারা জানান , প্রাকৃতিকভাবেই  প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। ফল মূল, শাক-সবজি এগুলো হলো ফাইবার৷ এখানে( ফরমালিন দেয়ার কোনো সুযোগই নেই৷ কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না৷ সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না৷ কারণ, এখানে কোনো প্রোটিন নেই৷ এছাড়া ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ও ইথোফেন ব‍্যবহার করা হয়। যা সারাবিশ্বে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা ২৪ ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে।
এবার আসুন, যুক্তি দিয়ে দেখি- আম চাষীরা ভরা মৌসুমে আসলে কেমিক্যাল ব‍্যবহার করে কি না? আর দিলেও কেন দিবে? আমার ধারণা, আম চাষীরা এই ধরনের কেমিক্যাল অন্তত ভরা মৌসুমে দেয় না। কারণ হচ্ছে ভরা মৌসুমে আম এমনিতেই পরিপক্ক থাকে এবং আম আধা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পারা হয়। এ সময় আম রেখে দিলে বা আম গাছ থেকে পারার পর ট্রান্সপোর্টের সময়টুকুতে আম এমনিতেই পেকে যায়। তাই ভরা মৌসুমে টাকা খরচ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর কোন প্রয়োজনই দেখি না। আর ভরা মৌসুমে প্রচুর আম বিক্রি হয়, দোকানে স্টক থাকে না। প্রচুর আম আসে, তেমনি প্রচুর আম বিক্রিও হয়ে যায়। এ সময় টাকা খরচ করে ফরমালিন কেন দিবে তা আমার বুঝে আসে না।
তবে কথা হচ্ছে, মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকাতে পারে। কারণ-তখন অপরিপক্ক আম তাড়াতাড়ি পাকিয়ে বাজারে ছাড়লে বেশি দাম পাওয়া যায়। অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকাতে পারে। আর মৌসুমের শেষে যখন বাজারে আম খুব কম পাওয়া যায়। কিছুদিন আমকে ধরে রাখতে পারলে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে তা বিক্রি করতে পারে। ঠিক সেসময় ব্যবসায়ীরা আমে ফরমালিন দিতে পারে। তাই, পুষ্টিকর ভাল আম খাইতে চাইলে ফলের মৌসুমের খাইতে হবে। 
আম এখন সারা দেশের ফল, যা বাণিজ্যিক কৃষির কাতারে পৌঁছে গেছে। এখন উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। পার্বত্য জেলার জুমচাষ এলাকায়ও উন্নত জাতের আম ফলছে। আম রফতানির সম্ভাবনা বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্ব। বিশ্ববাজারে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে , তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। এ দেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর এবং আশ্বিনা জাতের আম যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদিআরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানের রফতানি হচ্ছে। তবে বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ বিদেশে রফতানির জন্য সম্ভাবনাময় জাত। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে চলতি বছর বিদেশে আম রপ্তানির কোনও সম্ভাবনা নেই। আম চাষী ও ব্যবসায়ীদের দেশীয় বাজারে আম বিক্রির করতে হবে।
আমরা আসলে ফরমালিন আতঙ্কে ভুগছি৷ এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে৷ আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে ফল-মূল, শাক সবজি৷ এখন আমরা আতঙ্কে তা খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছি৷ এটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করছে৷ তাই যারা ফরমালিন আতঙ্কে আম খাওয়া থেকে বিরত আছে তারা মনের সন্দেহ ছেড়ে প্রকৃত সময়ে পাকা আম খেতে পারি । 

.
লেখকঃ জনসংযোগ কর্মকর্তা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইলঃ mbashirpro1986@gmail.com

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *