ভবিষ্যতের কৃষি স্বপ্ন ও বাস্তবতা : স্বপ্ন দেখি তা জলে তলিয়ে গেলেও

ভবিষ্যতের কৃষি স্বপ্ন

ভবিষ্যতের কৃষি স্বপ্ন

কৃষিবিদ ড. মোঃ মুজাহিদ-ই- রহমান

ভবিষ্যতের কৃষি স্বপ্ন ঃ”এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে”’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাকে গত কয়েকদিন আগে আমার গ্রামে নিজ হাতে তৈরী করা শখের বাগানে দাঁড়িয়ে ভাবলাম বারংবার। বাগানটি মিশ্র ফলের। গত বছর থেকে চলছে এর কাজ। গাছের ক্যানোপি ছোট থাকায় গত বছরের ন্যায় এ বছরও হলুদ লাগিয়েছি। ভাবছি প্রতি ইঞ্চি জমির এখানে নিশ্চিত ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয় জমির উর্ধমুখী ব্যাবহার হচ্ছে। কারণ এখানে ৪-৫ প্রকারে ফলের সাথে আছে হলুদ ও বেগুন । বলা যায় বিভিন্ন লেয়ার এ আছে গাছ। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পর আজ সকালে আমার গ্রাম থেকে বাগানের যে ছবিটা পেলাম তাতে খানিক থমকে গেলাম। আমার গাছ ? আমার হলুদ ? আমার বেগুন ? আমার লেবু? একি অবস্থা ? যেখানে বন্যার বা নদীর পানি কখনো ঢুকেছে বলে শুনি নি, দেখি নি সেখানে আজ হাটু জল। এ অবস্থা কেবল আমার জমির নয়, জব্বার চাচার, তার পাশের, সকলের। এখন কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। ভাবলাম, তাই কি ? আবারো ভাবলাম।মনে এলো জাপানের কৃষিকে কাছ থেকে দেখে আসার ছবি গুলি। তাদের আছে বছরের কয়েকমাস বরফে ঢেকে থাকার প্রকৃতি।

এই দুর্যোগ তাদের জন্মের সঙ্গী। এসব শীতপ্রধান দেশগুলোতে কি খাদ্যের সংকট আছে ? ঘরের ভিতর হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাক যেমন সারা বছর পাওয়া যায়, তেমনি সারা বছরে পাওয়া যায় ফ্রোজেন সবজি, আছে অন্ধকার ঘরেই উৎপাদিত মাশরুম আর বীন স্প্রাউট (মুগাঙ্কুর), বাজারে এসবের চাহিদা যেমন স্ট্যাবল তেমনি সরবরাহ নিয়মিত। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন এসবের ছাপ্লাই-চেইন ব্যাঘাত ঘটে না, ঘটে না কোনো কৃত্রিম সংকট। আরো একটু বিস্তারিত বলি। উন্নত দেশের কৃষি কেমন ? আমাদের ভবিষতের কৃষি কেমন হওয়া দরকার? এ কথার উত্তর ৩ টি ইংলিশ টার্মের মধ্যে আছে তা হলো protected agriculture, precision agriculture ও vertical farming.জাপানে থাকা অবস্থায় আমার বাসা হতে সুপার শপ যেতে বেশ কিছু গ্রীন হাউস পরে। একদিন একটু সুযোগ হলো একটির ভিতরে ঢুকার। সেখানে তারা সবজি উৎপাদন করে। বাহিরে যখন বরফ পড়ছে তখন তাদের সেই গ্রীন হাউসের ভিতর সুন্দর ভাবে শাক সবজি উৎপাদন চলছে। আর একদিন আমার এক ল্যাবমেটের বাসায় যেতে চাইলাম তার কৃষক বাবার কৃষি কাজ দেখতে। যা দেখলাম তাতে আমি অবাক। বিশাল এক ডুমুর গাছ একটি নেট এর ঘরের ভিতর। অর্থাৎ যত ডাল পালা হয়েছে ততই তা কাটা হয়েছে। নেট থাকার ফলে পোকা মাকড় ও ঢুকতে পারছে না। এটাই protected agriculture বা সংরক্ষিত কৃষি। জাপানের ৬০-৭০ ভাগ টমেটো ও স্ট্রবেরি protected agriculture এ উৎপাদিত হয়। একদিন আমার নিগাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লাবমেট লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম কি যেন এনালাইসিস করছে। মনে হলো অনেক রঙের খেলা। পরে জানলাম সে NDVI এনালাইসিস করছে। গাছের উপর ক্যামেরা ছিল সেই ক্যামেরা কিছুক্ষন পর পর ছবি নিয়েছে। গাছের এই রঙিন ছবিই বলে দিবে মাটিতে কতটুকু সার-পানি লাগবে। আর এক প্রফেসর একটা প্রজেক্ট উপস্থাপন করলেন।

তিনি দেখাচ্ছেন প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রীন হাউস এর সার পানি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করছেন তার চেম্বারের কম্পিউটার থেকে। একদিন ক্যাম্পাসে একটি টেকনোলজি ট্রান্সফার মেলা হল। সেখানে দেখলাম গহীন বনে কোনো গাছ মারা গেছে কিনা তা একটা ড্রোন পাঠিয়ে কম্পিউটেরে ভিডিও ও ছবি এনালাইসিস করে বুঝা যাবে। ধরুন ১০০ কিয়োলোমিটার দূরের আপনার জমি চাষ দিতে হবে বা ধান কাটতে হবে মানুষবিহীন ট্র্যাক্টর দিয়েই আপনি তা করতে পারবেন। এরূপ স্যাটেলাইটের সাহায্য নিয়ে যে কৃষি সেটাই precision agriculture নির্ভুল বা যথাযথ কৃষি। এর মাধ্যমে কৃষির অনেক সমস্যা বা কাজ স্যাটেলাইট ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমনকি স্মার্ট ফোন দিয়ে সমাধান করা যাবে। যেমন ধরুন স্যাটেলাইট আমাদের নির্ভুল পূর্বাভাস দিবে, উজানের বন্যার খবর দিবে মোবাইলে । আর আমরা ঢাকা থেকে রিমোট সেন্সিং ও জিপিএস ব্যবহার করে রোবোটিক্স কম্বআইনড হার্ভেস্টর দিয়ে আমাদের হাওরের ধান বন্যা আসার আগেই কেটে নিবো। এই মুহূর্তে অনেকটা কল্পনাতীত মনে হচ্ছে। কিন্তু অনেক দেশ এটি করে ফেলেছে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের স্টাডি টুর এ নিয়ে গেলো একটি হাই স্কুলে । সেখান থেকে ফেরার পথে নিয়ে গেলো স্ট্রওবেরি বাগানে। গ্রিনহাউস বা ঘরের মধ্যে সারি সারি ট্রে তে স্ট্রবেরি। তাকে তাকেও আছে। ফেরার সময় এবাৰ সুপার শপে গেলাম। লেটুস পাতা কিনলাম। কোনো মাটি পেলাম না লেটুসের নিচের পাতায় । জাপানিজ বন্ধুটাকে বললাম। ও বললো ইটা হাইড্রোপনিক সিস্টেমে উৎপাদিত। মাটি ছাড়াই পানিতে (গাছের খাদ্য উপাদান মিশ্রিত) উপাদিত সিস্টেম এটি। এর সাথে মাছ যুক্ত হলে হবে আকুয়াপনিক। আর মাটি ও পানি ছাড়াই তাকে তাকে ফসল ফলানো তা হলো আরোপনিক। টার্ম গুলি শুনে অবাক হলেও ওকে বুঝতে দিলাম না। আজ আমরা ছাদ বাগানে সন্তুষ্ট নই এখন কার্নিশ ও বারান্দা বাগান নিয়ে ভাবছি। দেশে আমার পূর্ববর্তী চাকুরী প্রতিষ্টানের (কৃষি গবেষণার) হাড্রোপোনিক আজ জনপ্রিয় হতে চলেছে।

এসব কিছুই বলতে গেলে vertical farming এর অন্তৰ্গত।আমাদের আছে মাঠঘাট সর্বত্র ফসলের সবুজ চাদর। হয়তো মাঝে মাঝে সিডর, আইলা, বন্যা-খরা, অতি বৃষ্টি, অনা বৃষ্টি কিছু অনিয়মিত দুর্যোগ-এ সেই সবুজের কিছু ছন্দ পতন ঘটায়। আর এসব অনিয়মিত দুর্যোগ যেন এখন নিয়মিত হতে চলেছে। তাহলে উপায় কি ? হা, বলছিলাম আমাদের অভিযোজনের কথা। কৃষিতে আমাদের পরিবর্তন আনার বাস্তবতার কথা। আমাদের দেশটি আস্ত এক গ্রীন হাউস। এই গ্রীন হাউসে ফসল ফলিয়ে তা প্রসেস করে (ফ্রোজেন, ড্রাই, প্যাকেট বা ক্যান) দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হোক সেই স্বপ্নই দেখুক আমাদের কৃষক ও উদ্যোক্তা। করোনা মহামারীর এই সংকট কালে চালের সংকট এই সবুজ বদ্বীপে হয়তো হবে না। তবে বাজারে পিয়াজ-মরিচের ধাক্কা আসবেই যদি আমরা এসব খাদ্য উদ্পাদনে এবং খাদ্য প্রসেস এ আরো গুরুত্ব না দেই, মহা পরিকল্পনা না নেই। অপরদিকে Protected agriculture, precision agriculture ও vertical farming এসব আজ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা। এ যেন আজ সময়ের চাহিদা।

লেখকঃ গবেষক, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, দিনাজপুর

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *