কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেলঃ
মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের কলাগাছিয়ার দক্ষিণ বাহাদুরপুর নামের প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় ২০টি পরিবার হাঁসের খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছে। সরকারীভাবে কোন সহযোগিতা না পেলেও নিজ উদ্যোগে এই খামারগুলো গড়ে উঠেছে। প্রায় ৫ বছর ধরে এই ব্যবসায় লাভবান হওয়ায় গ্রামের যুবকরা কর্মসংস্কারের জন্য খামারের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারী বা বেসকারী কোন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে ব্যাপকভাবে এই খামারের বিস্তার ঘটবে বলে স্থানীয়রা জানান।
সরেজমিনে স্থানীয় ও খামার ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের কলাগাছিয়ার দক্ষিণ বাহাদুরপুর গ্রামের বিল সংলগ্ন এলাকায় ইতিমধ্যেই নিজ উদ্যোগে বাড়ির গৃহবধু কিংবা গৃহকর্তাদের উদ্যোগেই ২০টি হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। আর এই খামারগুলোতে প্রায় ৩০ হাজার বড় হাঁস ও হাঁসের বাচ্চা রয়েছে। হাঁসগুলোকে প্রথম পর্যায় বাজার থেকে কিনে খাবার খাওয়ালেও পরে একটু বড় হলে গ্রামের ধান ক্ষেত, বিল, খাল ও নদী থেকেই এরা খাবার খেয়ে বড় হয়। কম খরচে অনেক লাভবান হওয়া যায় বলে গ্রামের অনেকেই এই কাজে উৎসাহ পাচ্ছেন। অপরদিকে সরকারীভাবে তারা কোন সুযোগ সুবিধা না পেলেও তাদের দাবী হাঁসগুলোর অসুখ হলে পরামর্শটা পেলেও তারা উপকৃত হবে। তাই খামারের ব্যাপারে তারা সরকারী বা বেসরকারীভাবে প্রশিক্ষণসহ সব ধরণের সহযোগিতা দাবী করেন।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, অখিল বালার প্রায় ১ হাজার ৫০০, দীপক বাড়ৈর ১ হাজার, অতুল হাজরার ১ হাজার, নিখিল বালার ১ হাজার, অচিন্ত্য বাড়ৈ ১ হাজার ৪০০, প্রশান্ত বাগচীর ৯০০, অরুণ বাগচীর ৩০০, রবি বাগচীর ৯০০, ক্ষীতি হাজরা, তারক বাড়ৈ ও শ্যামল মোড়লের ১ হাজার ৫০০, দীপক বাড়ৈ ও পঙ্গজ শিকারীর ১ হাজার ৫০০, গণেশ বাড়ৈর ১ হাজার, অসীম ভক্তের ৭০০, কেনারাম গাইন্ডা ৬০০সহ প্রায় ২০টি খামারে ৩০ হাজার হাঁস রয়েছে বলে খামার ব্যবসায়িরা জানান।
খামারের মালিক অখিল বালা ও তার স্ত্রী ইতি বালা বলেন, স্বামী-স্ত্রী আমরা দুজনেই হাসের খামারের যতœ নেই। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসারে অভাব ছিলো। তাই সুখের জন্য এই হাসের খামার গড়ে তুলেছি। গত বছর প্রায় লাখ টাকা লাভ হয়েছিলো। তাই এবারও প্রায় ১ হাজার ৫০০ হাসের বাচ্চা কিনে এনেছি। এই খামার ও হাসের বাচ্চা কিনে আনতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হাসের বাচ্চাগুলো বড় হবে। ডিম পারবে। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজারও বেশি ডিম পাওয়া যাবে এই খামার থেকে। সেগুলো বিক্রি করে আমাদের কমপক্ষে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হবে। অসুখেও কিছু হাঁস মারা যায়। তবে সরকারীভাবে কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনা। তবে আমাদের আর্থিকভাবে না হোক। অন্তত হাসের অসুখে কি ঔষুধ খাওয়াবো এটুকু জানতে পারলেই আমরা উপকৃত হবো।
আরেক খামারের মালিক অচিন্ত্য বাড়ৈ বলেন, আমি ও আমার দুই ছেলে অসীম বাড়ৈ ও অনিমেশ বাড়ৈ মিলে তিনটি খামার পরিচালনা করি। ছোট ছেলে খামারের কাজের পাশাপাশি পড়াশুনাও করে। আগামীতে এসএসসি পরীক্ষা দিবো। বৈশাখের প্রথম দিকেই হাঁস ও হাঁসের বাচ্চা কিনে আনি আমরা। এ বছর যশোর ও খুলনা থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা দিয়ে ১ হাজার ৫০০ বড় হাঁস ও ৪০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে এনেছি। যত বেশি এরা খাবার পাবে, তত তাড়াতাড়ি এরা বড় হবে। ৫/৬ মাস পরে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ এর মতো ডিম পাবো। এই ডিমগুলো আগে থেকেই চুক্তি করা রাজৈর, টেকেরহাটের আড়তদারদের গাড়ি এসে ডিমগুলো কিনে নিয়ে যাবে। এক হালি ডিম আমরা ৩২/৩৫ টাকা করে বিক্রি করে। হাসগুলো ডিম দেয়া বন্ধ করে দিলে আমরা হাসগুলো হাটে বিক্রি করে দেয়। আগামী বছর বৈশাখে আবার নতুন করে হাঁস কিনি। এ বছর আশা করছি সারে তিন লাখ টাকা লাভ হবে।
আরেক খামারের মালিক দীপক বাড়ৈ বলেন, আমাদের গ্রামের হাঁসের খামারের এই হাঁসগুলো লালন-পালন করতে খরচ অনেক কম হয়। কিন্তু লাভ অনেক বেশি হয়। কারণ এই হাসগুলোকে সকালে খামার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর হাঁসগুলো বিলের মধ্যে চলে যায়। সারা দিন ক্ষেত থেকে খেয়ে সন্ধ্যার সময় নিজ নিজ খামারে চলে আসে। এতে করে আমাদের হাসগুলোর জন্য আলাদাভাবে খাবার কিনতে হয়না। এমন কি আলাদাভাবে যত্নও নেয়ার প্রয়োজন হয়না। প্রকৃতিভাবেই এরা বড় হতে থাকে। তবে শুধু অসুখ হলে ভয়। কারণ সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে খামারের মালিকের দারুণ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অভ নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে খামারের ব্যাপারে খোজ খবর নেওয়া হয়েছিল। এরা সরকারীভাবে কোন সহযোগিতা পায়না। তাই সরকারের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোও যদি এদের পাশে দাড়ায়, সহযোগিতা করে, তাহলে এ অঞ্চল হাসের খামারের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। এতে করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি গ্রামের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ আসবে।
উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান মন্টু খান বলেন, হাঁসের বাচ্চাগুলো যখন খামার থেকে বের হয়, তখন দেখলে মনে হয় যেন নদীর স্রোত ঢেউ খেলছে। আসলে এগুলো আমাদের গ্রাম বাংলার সম্পদ। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খামারীদের আরো দক্ষ করে গ্রামের অর্থনৈতিককে বাড়াতে পারলে দেশও দ্রুত উন্নতি হবে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাসির উদ্দিন বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলো যাতে করে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরো দক্ষভাবে কাজ করতে পারে মাদারীপুর জেলা যুব উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত সেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. তরুণ কুমার রায় বলেন, গ্রামটি জেলা শহর থেকে অনেক দুর। প্রত্যন্ত এলাকা। তবুও আমি ঐ গ্রামে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। খামারীদের সাথে কথাও বলেছি। আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি। তাদের বলেছি-যে কোন ধরণের সমস্যায় অফিসে আসার জন্য কিংবা ফোন করেও হাসের অসুখের ব্যাপারে জানতে চাইলে পরামর্শ দেয়া হবে। আমরা সব সময় তাদের পাশে আছি।
কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com