নিতাই চন্দ্র রায়
নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে আউস ধানের চাষ হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় ২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে আউস ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৩ হাজার ২২৮ হেক্টর জমিতে বর্ষালী আউস ধানের চাষ করেছে কৃষক। এটা আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও পরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের জন্য একটি সুখবর। সুখবর বলছি এজন্য- আউস ধানে বোরো ধানের মতো এত সেচ সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। অল্প খরচে ও অল্প সময়ে কৃষক বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে এ ধান চাষ করতে পারেন। স্বাধীনতার পূর্বে দেশে বিশাল এলাকা জুড়ে হতো আউস ধানের চাষ । আউস ধানের একর প্রতি ফলন ছিল খুব কম। দেশী লাল রঙের আউস চালের ভাত খেতে মিষ্টি লাগতো। বেশি দিনের কথা নয় আজ থেকে ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী জেলার বিস্তীর্ণ চর এলাকা জুড়ে আউস ধানের চাষ হতো। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে এই কাটা ও মাড়াই করা ছিল বেশ কষ্টকর। তখন ধান মাড়াই যন্ত্রের এত প্রচলন ছিল না।
জৈষ্ঠ মাসের প্রথমে আউস ধান রোপণ করতে হয়। বর্তমানে আউস মৌসুমে পারিজা, বিআর-৫, বিআর-৪৮ ও নেরিকা-১০ জাতের ধানের আবাদই হয় বেশি। অনুকূল আবহাওয়া এবং রোগবালাইয়ে ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রব কম থাকায় এবার সারা দেশেই আউসের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের কথা এক বিঘা জমিতে এবার ১৮ থেকে ২০ মন ধান ফলেছে। দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতি মন আউস ধান বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দামে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ ফলনশীল নুতন জাত উদ্ভাবন, কম উৎপাদন খরচ ও সরকারি প্রণোদনা আউস চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করেছে। প্রতি বিঘা জমির জন্য একজন কৃষককে ২০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি এমওপি, ১০ কেজি ডিএপি ও নগদ ৪০০ টাকা সহায়তা দিয়েছে সরকার। বাজারে ধানের দামও ভাল। অন্য ধানের চেয়ে বর্ষালী আউসের আবাদে লাভ বেশি। প্রতি বিঘা আবাদে খরচ হয় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। বোরোর বেলায় যেখানে প্রতিমন ধানে লোকসান হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, সেখানে প্রতি বিঘা আউস ধানের আবাদে লাভ হচ্ছে ১০ হাজার টাকার ওপর- এটা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য বড় প্রণোদনা। লাভ বেশি হওয়ায় আগামী বছর আরো বেশি পরিমাণ জমিতে আউসের চাষ করবেন বলে জানায় বগুড়া ও নওগাঁ জেলার অনেক কৃষক।
কৃষির জন্য পানি এখন সবচেয়ে বড় সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় আমরা অনেক পানি পাই, আবার প্রয়োজনের সময় যতেষ্ঠ পরিমাণে পানি পাই না। এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে তা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সংকট বয়ে আনবে। তাই জলবায়ুর অভিযোজন মোকাবেলায় কৃষিকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি পানি ব্যবস্থাপনায় আরো সতর্ক থাকতে হবে। সম্প্রতি সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায়‘ কৃষি ক্ষেত্রে অভিযোজন প্রকল্প: অর্জন ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ কথা বলেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর সেচ মৌসুমে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। আর তেমনি তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষিকাজে অতিমাত্রায় সেচ নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে সেচের পানির অদক্ষ ব্যবহার এবং ভূউপরিস্থ পানি সংরক্ষণে জোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এ কারণে দেশের ভূউপরিস্থ পানির আধার পুকুর, খাল, বিলগুলিতে পানির অভাব দেখা দিচ্ছে।মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে। পানির অভাবে দেশের অনেক এলাকার কৃষক পাট থেকে আাঁশ ছাড়াতে পারছেন না। তীব্র খাবার পানির সংকটের জন্য বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি এক বিরাট সংকট সৃষ্টি করছে। তাই উত্তর বঙ্গের পানি নির্ভর কৃষিকে দক্ষিণবঙ্গে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবনের ওপর। এর পাশাপাশি কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যেও ন্যায্য মূল্য পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সেচের পানি প্রাপ্তি এবং সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিতে হবে।
এবছর বন্যাদুর্গত এলাকা ছাড়া অন্য অঞ্চলের আউস ধানের ফলন ভাল হয়েছে। রাজশাহী, পাবনা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরের চাষিরা প্রতি বছরের মতো এবারও দেশী জাতের আউস ধানের চাষ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, চলতি আউস মেসৈুমে ১০ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে।এবছর নেরিকা-১০ ও ব্রি-৪৮ জাতের ফলন ভালো হয়েছে। এসবজাতের ধানে হেক্টর প্রতি ৪ টনের বেশি ফলন হয়েছে। আউস মৌসুমে চাষিদের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের বীজ সরবরাহ করা সম্ভব হলে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বেড়ে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কম সেচের ও ভূগর্ভের পানি কম ব্যবহার করে আউস উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক কেজি ধান উৎপাদনে ২৫০০ থেকে ৩০০০ কেজি পানির প্রয়োজন হয়। তাই বোরো মৌসুমে ধানের পরিবর্তে গম, ভুট্টা, ডাল তেল ও অন্য ফসল উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় আউসের আবাদ কম।তাই বন্যার কারণে আউস উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না। এবার পাটের আবাদ বেশি হওয়াতে পাট কাটার পার কৃষক বেশি পরিমাণ জমিতে আমন ধান লাগাবেন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সম্প্রতি বন্যায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির আউস ধান নষ্ট হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে আউস ধানের প্রতি অবহেলা ও গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আউস আবাদি জমি দুই তৃতীয়াংশ কমে গেছে এবং বেড়ে গেছে সেচ নির্ভর বোরো ধানের চাষ। বোরো ধানের আবাদের জন্য ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ পানি। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে চলে যাচ্ছে।সংকট হচ্ছে সুপেয় পানির। বাড়ছে আরসেনিক দূষণ। উত্তরাঞ্চলে মরুময়তার প্রভাব পরিরক্ষিত হচ্ছে।ধান উৎপাদনে সেচের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে তাই আউস চাষে সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করা হচ্ছে প্রণোদনা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেশে উৎপাদিত মোট ধানের মাত্র শতকরা ৭ ভাগ উৎপাদিত হয় আউস মৌসুমে। তাই আউস ধানের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বাড়ানো যতেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন নিবিড় চাষি যোগাযোগ ,চাষি উদ্বুদ্ধ করণ, প্রদর্শনী প্লট স্থাপন এবং মাঠ দিবসসহ সম্প্রসারণ কর্মকা- জোরদার করণ। এব্যাপারে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
——————–
লেখকঃমহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগারমিলস্ লিঃ,গোপালপুর, নাটোর
—-
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম