কৃষিবিদ মোঃ সাইদুল ইসলামঃ
বাগান করা আমার বহুদিনের শখ। ফ্লাট বাসায় ৩য় তলায় থাকলেও মন মানে না। তাই মাত্র ১০ হাত দৈর্ঘের ব্যালকনিতেই শুরু করলাম বাগান করা। সবাই ব্যালকনিতে ফুলের বাগান করলেও আমি করেছি ফল ও সবজি বাগান। গত দুই বছরে এখানে যেসব ফলিয়েছি-
১. বেগুন
২. মরিচ (ক্যাপসিকামসহ চার জাতের)
৩. টমেটো (তিন জাতের)
৪. পুইশাক
৫. ডাটা
৬. পুদিনা পাতা
৭. ধনে পাতা (দুই ধরনের)
৮. ঢেঁড়স
৯. শসা
১০. চাল কুমড়া
১১. করলা
১২. পেঁয়াজ
১৩. রসুন
১৪. আঙ্গুর
১৫. কমলা
মাত্র ১০ হাত দৈর্ঘের পূর্বমুখী ব্যালকনিতে এতকিছু চাষ করতে গিয়ে যে টেকনিকগুলো অবলম্বন করেছি-
১. চাষ করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছি হলো সূর্যালোক ঠিকমতো না পাওয়া। এজন্যে ব্যালকনির গ্রীলের সাথে আনুভুমিকভাবে বিশেষ পদ্ধতিতে মাচা বসিয়েছি। গাছ
গুলোকে দুইভাবে বাড়তে দিয়েছি। এক হলো- মাচার দিকে আনুভুমিকভাবে, আর গ্রীলের দিকে উলম্বভাবে। তাতে গাছের পাতায় সূর্যালোক গ্রহণের প্রতিযোগিতা কম হয়।
২. এরপরও যেসব পাতা সূর্যালোক না পায় যেসব পাতা নিয়মিত ছেঁটে ফেলি, তাতে গাছের প্রস্বেদন খরচ কমে যায়। ফলে গাছের সঠিক বৃদ্ধি
ও ফলন ভালো হয়।
৩. এখানে কোন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করিনি। তবে খুব প্রয়োজন না হলে ২-১ বার fungicide স্প্রে করেছি মাত্র। আর কেমিক্যাল সারও খুব একটা ব্যবহার করিনি। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হলে জৈব পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। আর ৩য় তলায় সাধারণত পোকা-মাকড় ও রোগের আক্রমণ একটু কমই হয়। কারণ বেশি এতো উঁচুতে Isolation distance অনেক বেশি।
৪. গোবর ও খৈলের সাথে ইউরিয়া মিশিয়ে পঁচিয়ে গাছের গোড়ায় ব্যাবহার করেছি। ৫০% গোবর ও খৈল+৫০% মাটি।তবে প্রয়োজন মাফিক মাইক্রোনিউট্রিয়েন ও অন্যান্য সারও মাটিতে বা পাতায় স্প্রে করেছি পরিমিতভাবে।
৫. গাছের গোড়ায় মাটির পরিমাণ অতি অল্প ব্যবহার করেছি। একটা ২.৫ লিটারের সেভেন আপের বোতলকে লম্বালম্ভি কেটে তাতে ২-৩ টা গাছ রোপন করেছি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, প্রতিটা গাছ কত অল্প মাটি পেয়েছে !! এরপরও গাছের সঠিক বৃদ্ধিতে কোন সমস্যা হয়নি। কারণ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ও পানি নিয়মিত দিলে এবং সূর্যালোক নিশ্চিত করতে পারলে গাছের গোড়ায় এতো মাটির প্রয়োজন পড়ে না।
৬. গাছে পানি দেওয়ার জন্যে পানির বোতলে স্যালাইনের পাইপ বসিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি যাতে বার বার পানি দেওয়ার ঝামেলা পোহাতে না হয়।
৭. ছাদে বাগান করার চেয়ে ব্যালকনিতে বাগান করা বেশি সুবিধা। কারণ ছাদে অত্যধিক তাপে গাছ ঝলসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ব্যালকনিতে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
৮. ১০ হাত দৈর্ঘের পূর্বমুখী আমার ছোট্ট ব্যালকনি। তবে এটা দক্ষিণমুখী হলে আরো বেশি ফসল ফলানো সম্ভব হতো। কারণ দুপুর ১২টার পর এখানে সূর্যালোক পাওয়া যায় না।
৯. আরেকটি টেকনিক জানা দরকার সেটি হলো- গাছে ফুল-ফল ধরাকালীন সময়ে কখনোই ইউরিয়া বা নাট্রোজেন জাতীয় সার ভুলেও দিবেন না। এসময় নাট্রোজেন জাতীয় সার দিলে গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফল ধারণে স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয় যা গাছের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়। তাই নাট্রোজেন জাতীয় যাবতীয় সার গাছ রোপনের আগে বা বাড়ন্ত অবস্থায় দিবেন, ফুল-ফল ধারণের সময় নয়। এটার সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা আছে, কেউ জানতে চাইলে অন্য কোন পোস্টের মাধ্যমে বলবো।
১০. এতো উঁচুতে পরাগায়ণের জন্যে প্রয়োজনীয় বাহক পোকা না থাকায় অনেক সময় অকালেই ফুল ঝরে পড়ে। এজন্যে যা করতে হবে তা হলো – ফুলের গোড়া থেকে একটু নিচে গাছের ডালে আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিবেন, যাতে ফুলে আচমকা ঝাকুনি লাগে। সকাল 11 এটা হতে দুপুর 1 টার মধ্যে এ কাজ করতে হবে। এ সময় গর্ভমুন্ড পরাগ গ্রহণের জন্যে রেডি থাকে। এ পদ্ধতিটি টমেটো ও মরিচের জন্যে কার্যকরী।
১১. টবে বা বোতলে মাটি ভরার আগে বোতল বা টবের তলদেশে অবশ্যই কতগুলো ছিদ্র করে নিবেন বাড়তি পানি বের করে দেওয়ার জন্যে। গাছের গোঁড়ায় ৩-৪ ঘন্টার বেশি পানি জমে থাকা যাবে না। গাছের গোড়ায় দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকলে গাছ মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে না। খেয়াল রাখতে হবে- মাটি ভেজা থাকবে, কিন্তু পানি জমে থাকা যাবে না।
বর্তমানে আমরা প্রতি ৪-৫ দিন পরপর টমেটো হার্ভেস্ট করছি প্রায় ১ ডালি করে (প্রায় ৫ কেজি)। বর্তমানে আমাদের ৫ জনের ফ্যামিলির চাহিদা মিটিয়েও অনেক টমেটো উদ্বৃত্ত্ব থেকে যায়।যদিও আমরা টমেটো খেতে খুব পছন্দ করি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রতিটা গাছে যে পরিমাণ টমেটো ধরেছে তার ওজন করলে তার গোড়ার মাটির ওজনের চেয়ে কম পক্ষে ৪০-৫০ গুণ বেশি হবে !!! এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। বিশ্বাস না হলে বাসায় এসে দেখে যেতে পারেন।
আর এই বাগান থেকে যে পরিমাণ মরিচ পাওয়া যায় তা দিয়েই আমাদের চলে যায়। বাড়তি মরিচ কিনতে হয় না বলেই চলে। বর্ষাকালে যখন কাঁচা মরিচের অনেক দাম থাকে তখন আমরা বাজার থেকে মরিচ একেবারেই কিনি না। আমাদের বাগানের মরিচেই চলে যায় অনায়েসেই।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন বাসার মালিক কিছু বলে না?
না, মালিক খুব ভাল। বরং তারা আমার বাগান করা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার কাছ থেকে চারা ও প্রযুক্তি নিয়ে তারাও ৩য় তলার অপর ফ্লাটের ব্যালকনিতে বাগান করা শুরু করে দিয়েছে।আশেপাশের বাসা থেকে অনেকেই আমার ব্যালকনির বাগান দেখতে আসেন। কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে ইতোমধ্যে উনারাও বাগান করা শুরু করে দিয়েছেন। যারা ফ্লাট বাসায় থাকেন তারা আমার পদ্ধতিতে বাগান করতে পারেন অনায়েসেই। বাজারের কেমিক্যালযুক্ত সবজি খাওয়ার চেয়ে নিজে বাগান করে বিষমুক্ত ফ্রেশ সবজি পেতে আমার পদ্ধতি খুবই কার্যকর হবে।
আমার এই বাগান করে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বীজ থেকে একটি গাছ কিভাবে পূর্ণাঙ্গ গাছে রূপান্তর হয়ে তাতে ফুল ও ফল ধরে তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। প্রতিটা গাছ আমার সন্তানের মতো। প্রতিবেলা নিজে খেতে বসার আগে মনে পড়ে গাছে ঠিকমতো পানি দেওয়া হয়েছে কিনা। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কৃষিবিদ হওয়ায় কৃষির যাবতীয় টেকনোলজি এখানে এপ্লাই করার সুযোগ পাই। তাতে সেই টেকনোলজি সম্পর্কে আমাদের কনফিডেন্ট বাড়ে।
কিছুদিন আগে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়ে গেলো। তাতে আমাদের বাগানের অনেক গাছের ডালপালা ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা ডালগুলো আদরের সাথে ধারালো ছুরি দিয়ে তীর্যকভাবে কেটে তা ব্যান্ডেজ (গ্রাফটিং) করে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিই এবং ভাংগা অংশে পাতা ছেঁটে দিই প্রস্বেদন কমানোর জন্যে। তাতে একটি ডালও মরে যায়নি।
লেখকঃ পিএইচডি গবেষক ও আইটি বিশেষজ্ঞ,কৃষিবি্দ
Really nice. It is important to inform all the people about it. Pesticide free vegetables production is very much essential for health.