মোঃ মোশারফ হোসেন, (শেরপুর) ঃ
সুগার বিট চাষে সফলতা
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই),ঈশ্বরদী; পাবনার ফিজিওলজি এন্ড সুগার কেমিস্ট্রি বিভাগের বাস্তবায়নে ও বিএসআরআই-এর সমন্বিত গবেষনা কার্যক্রম জোরদারকরন প্রকল্পের সহযোগিতায় এবং বিএসআরআই জামালপুর উপকেন্দ্রের আওতায় সুগার বিট চাষে সফলতা পাওয়া গেছে। এর ফলে চিনি তৈরীতে আখের পরিবর্তে সুগার বিটের মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত ও সমৃদ্ধ করতে নতুন আশা দেখা দিয়েছে। তবে ব্যাপকভাবে এই ফসলের চাষ বৃদ্ধি ও চিনি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সব উঁচু ও মাঝারি উঁচু এবং অনাবাদি জমিতে এর চাষ করতে পারলে এবং স্বল্প ব্যয়ে চিনি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারলেই কৃষক হবেন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান; এমনটাই মনে করছেন ইক্ষু ও কৃষি গবেষকরা।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে এদেশে উপযোগীতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা মূলকভাবে বিভিন্ন এলাকায় সুগার বিটের চাষকরা হচ্ছে। তার ধারাবাহিকতায় চলতি মৌসুমে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জামালপুর উপকেন্দ্রের আওতায় চার বিঘা জমিতে প্লট আকারে চিনি উৎপাদন হয় এমন জাতের সুগার বিট চাষ করা হয়েছে। তারমধ্যে শেরপুরের নকলা উপজেলার পাঠাকাটা ইউনিয়নের পাঠাকাটা গ্রামে দুই বিঘা, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জামালপুর উপকেন্দ্র এলাকায় এক বিঘা এবং জামলপুরের অন্য এলাকায় এক বিঘা জমিতে সুগার বিটের উপযোগীতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা মূলকভাবে চাষকরে ব্যাপক সফলতা পাওয়া গেছে। ফলন দেখে অনেকেই মনে করছেন, সমতল এবং উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমির অন্য আবাদের চেয়ে সুগার বিটের উৎপাদন বেশি। তবে উৎপাদিত সুগার বিট থেকে আজও চিনি তৈরী করা শুরু হয়নি। সুগার বিট থেকে চিনি তৈরীকরা শুরু হলে এর চাষ দেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই।
আশার বিষয় হলো- সরকার ইতোমধ্যে ঠাকুড়গাঁও সুগার মিল লিমিটেড কোম্পানীতে সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদনের জন্য ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আলাদা মেশিন সংযোজনের কাজ শুরু করেছে। ২০১৯ সালের দিকে ওই কোম্পানীতে সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করছেন, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটর কর্মকর্তাগন। তারা জানান, দেশে চিনির চাহিদা পূরণের জন্য প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিকটন চিনি বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। কিন্তু এদেশে সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদন করা শুরু হলে আমদানীর পরিমাণ অনেক কমে আসবে। তাতে চিনি আমদানী বাবদ কোটি কোটি টাকা বিদেশে যাওয়া হ্রাস হবে, পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।
নকলা কৃষি অফিসের সিটিজেন চার্টের মতে, প্রায় ১৭৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট নকলা উপজেলার ৩০ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমি আবাদি এবং প্রায় ৭০০ হেক্টর জমি বরাবর পতিত থেকে যায়। এক ফসলী জমিসহ উপজেলার সব পতিত জমিতে সুগার বিট চাষ করা সম্ভব।
উপজেলার পাঠাকাটা ইউনিয়নের পাঠাকাটা গ্রামের সুগার বিট চাষী লিটন মিয়া জানান, তিনিসহ তার এলাকার প্রায় সব কৃষক বাপ-দাদার আমল থেকেই আখ চাষ করে আসছেন। আখ চাষে ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লাগে, তাতে আখচাষের জমিতে দেড় বছরের মধ্যে অন্য কোন আবাদ করা সম্ভব হয়না। ফলে আখচাষে কৃষকের আগ্রহ কমে যাওয়ায় দিন দিন আখের আবাদ কমছে। তাতে আনুপাতিক হারে চিনি আমদানীর পরিমাণ বাড়ছে। অপর দিকে সুগার বিট চাষে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ মাস। তাতে সুগার বিট তোলার পরে ওই জমিতে কমপক্ষে আরও একটি আবাদ করা সম্ভব। তিনি এবছর দুই বিঘা জমিতে সুগার বিট রোপন করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে, এর এক বিঘা জমির সুগার বিট গাছের ফাঁকে ইতোমধ্যে আখ লাগিয়ে দিয়েছেন। একই জমিতে বছরে দুইটি আবাদ, বিশেষ ক্ষেত্রে এক সঙ্গে দুইটি আবাদ করা সম্ভব হওয়ায়, সুগার বিট চাষে কৃষকরে আগ্রহ বাড়ছে। চিনি উৎপাদনকারী এই ফসলের (সুগার বিটের) সন্ধান পেয়ে কৃষক খুব খুশি। তিনি জানান, তার দেখা দেখি শখ করে তার ক্ষেত থেকেই কিছু সুগার বীটের চারা নিয়ে পাঠাকাটা এলাকার বাচ্চু মিয়া, জিয়ারুল হক ও লূৎফর তাদের আখ ক্ষেতে লাগিয়েছেন। তাদের আখ ক্ষেতের সুগার বিটের গাছ দেখে অন্যরাও আগ্রহী হয়েছেন। ওই এলাকার অন্যএক কৃষক আমিনুল ইসলাম জানান, আগে বর্ষকালে নিচু জমি পতিত পড়ে থাকত, শুকনা মৌসুমে কিছু জমিতে ধান চাষ করতে পারতেন। কিন্তু ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের পরামর্শে গত বছর ওইসব জমিতে জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ইক্ষু চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। তাই চলতি বছর ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু আখের আবাদ দ্বিগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে উঁচু ও মাঝারি উঁচু এবং পতিত জমিতে সুগার বিট চাষে সফলতার সম্ভাবনার দেখা দিয়েছে। এতে কৃষি ক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার পথ খোঁজে পেয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জামালপুর উপকেন্দ্রের কৃষি ওভারশিয়ার মোঃ আল মামুন জানান, সাধারনত অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে সুগার বিটের বীজ বপন করতে হয়, আর তোলার উপযোগী হয় চৈত্র-বৈশাখ মাসে। এই ফসলে রোগবালাই ও পোকা মাকড়ের উপদ্রব বেশি হওয়ায় নিয়মিত বালাই ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া অন্যসব আবাদের মতো পরিমিত পরিমানে জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং প্রয়োজনে সেচ দিতে হয়।
নকলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, ক্রমবর্ধমান মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনেই দিন দিন আবাদি জমি কমছে। এমতাবস্থায় কোন জমি অনাবাদি থাকলে তাতে কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল না হয়ে, উল্টো স্থবির হয়ে পড়তে পারে। তাই পতিত জমিকে কাজে লাগাতে সুগার বিট চাষ বাড়ানো জরুরি। এর জন্য সরকারকে দ্রুত সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদন শুরু করা জরুরি মনে করছেন সুধীজন। তাতেকরে দেশের কৃষি আয় বাড়বে, কমবে চিনি আমদানীর ব্যয়।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জামালপুর উপকেন্দ্রের ইনচার্জ ড. খন্দকার মহিউল আলম জানান, বাংলাদেশের মাটি সুগার বিট চাষের জন্য উপযোগী। উপযোগীতা যাচাইয়ে এদেশে চিনি উৎপানদকারী সুগার বিট চাষের গভীর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদনে সরকারি পৃষ্টপোশকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে, দেশের মোট জমির ব্যবহার বাড়বে, কমবে পতিত জমির পরিমাণ। তাতে একদিকে চিনি আমদানী ব্যয় কমে, গতি পাবে কৃষি অর্থনীতি; অন্যদিকে কৃষক হবেন স্বাবলম্বী, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, কমবে বেকারের সংখ্যা।