ড. মোঃ আবুল কাসেম
খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব
ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য শুধু মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না বরং সমগ্র জীবজন্তু তথা পরিবেশের সুদূর প্রসারী ক্ষতি করে। খাদ্যদ্রব্য মৌলিক চাহিদার অন্যতম যা ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, সচেতন-অসচেতন সবাইকে গ্রহণ করতে হয়। এমনকি পশু পাখিও তার ব্যতিক্রম নয়। আর সেই খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরণের অমানবিক কাজ। মানুষ ও জীবজন্তুর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি খাদ্যের উপাদান দ্বারাই পরিচালিত হয়। কাজেই খাদ্যে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ঐ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলির প্রভূত ক্ষতিকরে। বর্তমানে ব্যাপক ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, রক্তের উচ্চ চাপ ও নিম্ন চাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি বড় বড় রোগের মূল কারণ হিসেবে এই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশ কনজিউমার রাইট সোসাইটির দেয়া তথ্য মতে ভেজাল খাদ্যে প্রতিবছর প্রায় তিন লক্ষ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডায়াবেটিস এবং দুই লক্ষ লোক কিডনিতে আক্রান্ত হয়।
ফসল ও খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য
বেন্জিমিডাজল, কার্বোক্সিমাইড, মেলাথিয়ন, সাইপারমেথ্রিন, এন্ড্রিন, বিএইচসি, এল্ড্রিন, ডায়েল্ড্রিন, হেপ্টাক্লোর, ক্লোরডেন, থায়োডিন, ফরমালিন, রেড অক্সাইড, ডিডিটি, হরমোন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, সোডিয়াম কার্বাইড, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, পোড়া মবিল, টেক্সটাইল রং, লেদার রং, বস্ত্রকলের বিষাক্ত রং, ইউরিয়া, হাইড্রোজ, গোলাপী রোডামিন-বি রং, অ্যারোকোলিন নামক বিপজ্জনক রাসায়নিক, কমলা বা কিশোরী বর্ণের কোল্টার রং, মেটানিল ইয়োলো, উজ্জল অ্যালুমিনিয়াম ফোয়েল-টক্সিন, চিনির বিকল্প হিসেবে পেট্রোলিয়াম জাতিয় স্যাকারিন, ট্যানারি বর্জ্য, চামড়ার ভূষি ইত্যাদি ভয়ানক ক্ষতিকর রাসায়নিক বিভিন্ন প্রকার খাদ্য ও ফসলে ব্যবহার করা হয়।
যে সকল ফসল ও খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়
দানাজাতীয় ফসল, ডাল ফসল, তেল ফসল, শাকসব্জি, খেজুর, টমেটো, কলা, আম, পেঁপে, নাশপাতি, কুল, আপেল, কমলা, পেয়ারা, আনারস, জাম, জামরুল, তরমুজ, বাংগি, আঙ্গুর, মাছ, মাংস, দুধ, জিলাপি, চানাচুর, বিস্কুট, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস, মুড়ি, বেভারেজ, আইসক্রিম, সুপারি, রঙিন জিরা, পানের মসলা, গুড়, কমলা ও হলুদ রঙের মিষ্টি, উজ্জ্বল সন্দেশ, বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার, দই, মুরগি ও মাছের খাবার ইত্যাদি।
ফসল ও খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতির প্রকৃতি
বিভিন্ন রাসায়নিক অতিমাত্রায় ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করায় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লিভার ও কিডনির ক্ষতি করে। এছাড়া শ্বাস-কষ্ট, চর্ম রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া নাকের প্রদাহ, অ্যাজমা, রক্তের লিম্ফোসাইটে পরিবর্তন, ক্যান্সার, ডিএনএ পরিবর্তন, গর্ভস্থ ভ্রূণের অস্বাভাবিকতা, গর্ভপাত, অকাল মৃত্যুসহ নানারুপ অঙ্গহানি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ফরমালিনের সংস্পর্শে কাজ করলে ন্যাজাল ক্যান্সার, ন্যাসোফেরিন্জিয়াল ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, ব্রেন ক্যান্সার ও ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে (ন্যাশন্যাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, ইউএসএ)। তাছাড়া পাকস্থলি প্রদাহ, লিভার ও অস্থি মজ্জার ক্ষতি, তীব্র মাথা ব্যথা, ঘূর্ণন রোগ, প্রলাপ, মেজাজ খিটখিটে, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, লোহিত কনিকার ক্ষতি, ত্বক, মূত্রথলি প্রদাহ, চর্মরোগ ও এলার্জি হতে পারে। কিছু কিছু রাসায়নিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর ও কার্সিনোজেন হিসেবে কাজ করে এবং অতি ব্যবহারে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয় যেমন খাবার থেকে মুরগির মাংস ও ডিম বিষাক্ত হয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়, গর্ভবতীর সন্তান প্রসবের জটিলতা সৃষ্টি হয়, সন্তানের জন্মগত ত্রূটি, প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা, বিকলাঙ্গ ইত্যাদি সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও সহজেই যে কোন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ফরমালিনযুক্ত খাদ্যে মানুষের তাৎক্ষনিক মৃত্যুও হতে পারে । (চলবে)
…
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)
ময়মনসিংহ
ইমেইলঃ kashembina@gmail.com