বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট- বিএফআরআই গবেষণা কার্যক্রম (পর্ব-২)

বিএফআরআই গবেষণা কার্যক্রম

জান্নাত ঝুমা

(পূর্ব প্রকাশের পর)

চ) হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা
হালদা নদী রুই জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। এ নদীতে উৎপন্ন পোনা ব্রুড উৎপাদনসহ মাছ চাষে ব্যবহৃত হয়। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট এবং পানি দূষণের কারণে হালদা নদী হতে মাছের নিষিক্ত ডিম উৎপাদনের পরিমান দিন দিন হৃাস পেয়েছে। উল্লেখিত কারণে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট হালদা নদীর পরিবেশ, প্রতিবেশ, পানির গুণাগুণ ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার প্রভাব নির্ণয়ের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, রুই জাতীয় মাছের বিশুদ্ধ পোনা প্রাপ্তি তথা প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংক্ষণের স্বার্থে হালদা নদীতে সারা বছর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষে ইনস্টিটিউটে কর্তৃক প্রণীত বেশ কিছু সুপারিশ বর্তমানে সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।

ছ) ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে ষষ্ঠ অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ
জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে জন্যঅভয়াশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্যে ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর হতে বিগত পাঁচ বছরের ধারাবাহিক গবেষণায় নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা, পানির গুণাগুনও পানির প্ল্যাংটন (খাদ্যকণা) প্রাচুর্যতার ভিত্তিতে ষষ্ঠ অভয়াশ্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত এলাকা সমূহ হচ্ছে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার নাছাকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট ও ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর পয়েন্ট এবং বরিশাল সদর উপজেলার জুনাহার পয়েন্ট মোট এলাকা হচ্ছে প্রায় ৮২ কিলোমিটার। উক্ত এলাকায় ইলিশ/জাটকার ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে প্রায় ৪,৩০০ কোটি অতিরিক্ত জাটকা ইলিশ জনতায়  যুক্ত হবে বলে আশা করা যায় ।

জ) উপকূলীয় জলাশয়ে নোনা টেংরাও পারশে মাছের পোনা উৎপাদন ওচাষ সম্প্রসারণ

ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা খুলনা জেলার পাইকগাছাস্থ লোনাপানি কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে নোনা টেংরা ও পারশে মাছের ব্যাপক পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। উপকূলীয় এ দুটি মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং পোনা উৎপাদনের কালে উপকূলীয় অঞ্চলে এদের চাষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নোনা টেংরা মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভবানের জন্য ইনস্টিটিউট জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০০৯স্বর্ণপদক লাভ করে। উল্লেখ্য উপকূলীয় ঘেরে চিংড়ি মাছের বিভিন্ন রোগবালাই হওয়ায় চাষীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে চিংড়ির সাথে নোনা টেংরা ও পারশে মাছের মিশ্র চাষ করা হলে ক্ষতি পুষিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ঝ) হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন

প্রাকৃতিক পরিবেশে জোয়ার-ভাটা বিধৌত প্যারাবন সমৃদ্ধ মোহনা এলাকায় কাঁকড়ার আবাসস্থল। পরিপক্ক স্ত্রী কাঁকড়া ডিম ও পোনা ছাড়ার জন্য গভীর সমুদ্রে পরিব্রাজন করে বিধায় হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য বেরিড বা মা কাঁকড়া পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।ইনস্টিটিউটের পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রেপর্যায়ক্রমিক গবেষণার মাধ্যমে পরিপক্ক মা কাঁকড়া হতে প্রজনন উপযোগী ডিম বহনকারী  মা কাঁকড়া উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে, ৩০ পিপিটি মাত্রার লবণ পানি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ৬৯% কাঁকড়া উৎপাদিত হয়েছে, যাদের ডিম নিষিক্তের হার গড়ে ৯৩% এবং পোনা উৎপাদনের সাফল্য ৯৮% পর্যন্ত পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য হ্যাচারীতে কাঁকড়ার পোনা মৃত্যু হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বর্তমান গবেষণা অব্যাহত আছে।

ঞ) উপকূলে সী-উইড চাষ

ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র থেকে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন সী-উইডের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। গবেষণা পর্যবেক্ষণে কক্সবাজারস্থ সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাকখালী মোহনা ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ প্রজাতির সী-উইডের সন্ধান পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ১০ প্রজাতির সী-উইডকে বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। অত:পর৩ প্রজাতির সী-উইড সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী ও বাকখালীতে চাষ করা হয়। মোট ৬০ দিনের চাষে প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ১ কেজি পর্যšত সী-উইড উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপ নয় উপকূলের সুবিধাজনক ¯হানে সী-উইড চাষ করা। যেকোন খাদ্যে পরিমিত পরিমাণ সী-উইডের পাউডার বা সিদ্ধ করা তরল নির্যাস ব্যবহার করে খাদ্যের (স্যুপ, সালাদ, নুডুলস ইত্যাদি) পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

ট) ‘‘বিএফআরআই মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার” ব্যবহারের মাধ্যমে গুণগতমানসম্পন্ন শুটকি মাছ উৎপাদন

স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ শুটকি তৈরীর লক্ষ্যে বিএফআরআই এর সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার কর্তৃক সময় সাশ্রয়ী ও দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগী ‘‘বিএফআরআই মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার” উদ্ভাবন করা হয়েছে। ড্রায়ারটিতে সৌর ও বিদ্যুৎ শক্তি উভয়ই ব্যবহার করা যায়। ফিশ ড্রায়ারের মূল কাঠামো মেটালিক যা জিআই পাইপ/এংগেল বা এসএস-বারএর তৈরি। এর একদিকে বাতাস প্রবেশের জন্য ছোট মেশের জালের দরজা ও অন্য দিকে বাতাস বের হওয়ার জন্য এক বা একাধিক এগজস্ট ফ্যান লাগানো থাকে। জালের দরজা ছাড়া কাঠামোর সকল পাশে ৯ মিমি পুরুত্বের স্বচ্ছ সেলুলয়েড পলিথিন লাগানো। রাতে বা মেঘলা দিনে মাছ শুকানোর জন্য এই ড্রায়ারে হট এয়ার ফ্যান বা হিটিং কয়েল স্থাপন করা হয়। স্বচ্ছ সেলুলয়েডের মধ্য দিয়ে সূর্য কিরণ ড্রায়ারে প্রবেশ করে ও পাটাতনের কালো অংশে শোষিত হয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় যা ভেতরের বাতাসকে গরম করে। এই গরম বাতাস ফ্যানের মাধ্যমে মাছের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দ্রুত মাছ শুকিয়ে যায়। নিরাপদ শুটকি প্রনীতে অনেক উদ্ধোক্তা বর্তমানে এই ড্রয়ার ব্যবহার করে।

ঠ) ইনস্টিটিউটের গবেষণা জোরদারকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণ ইনস্টিটিউট কর্তৃক উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্র্র্র্রামীণ কর্মসংস্থান, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের জন্য বর্তমান মৎস্য বান্ধব সরকারের আমলে ৯ বছরে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ইনস্টিটিউটে ৭ টিসমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ৪টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *