আলাদা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেইঃ ঘাস খাইয়ে গবাদিপশুর মোটাতাজাকরণ সম্ভব

আলাদা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেইঃ ঘাস খাইয়ে গবাদিপশুর মোটাতাজাকরণ সম্ভব
আলাদা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেইঃ ঘাস খাইয়ে গবাদিপশুর মোটাতাজাকরণ সম্ভব
গবেষণারত ড. আল মামুন সহ অন্যান্যরা

আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি থেকেঃ

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে দেশে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আশির দশকে শুরু হয়েছিল গ্রোথ প্রোমোটার বা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। এটি এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্নভাবে পশুর মেটাবলিজমের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এসব সিনথেটিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার প্রাণিদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করে। এসব ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ মাংস, দুধ ও ডিম ভক্ষণের ফলে মানুষের মাঝেও ব্যবহার পরবর্তী (রেসিডিউয়াল) ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ করা যায়। এতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দেখা দেয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হার্ট ডিজিস, ডায়াবেটিস, অটিজমসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগের কারণ এটি। ৯০’র মাঝামাঝি থেকে পশুখাদ্যে এসব ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে প্রায় তিন দশক ধরে গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের পর এর ক্ষতির দিক অনুধাবন করে ২০০৬ এর ১ জানুয়ারি থেকে পশুখাদ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করে। বিজ্ঞানীরা মেতে ওঠেন গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প পশুখাদ্য উদ্ভাবনের নেশায়। গবেষণায় দেখা যায়, মেডিসিনাল উদ্ভিদ বা প্রাকৃতিক হার্বস হতে পারে বিকল্প পশুখাদ্য। যদিও মেডিসিনাল উদ্ভিদের ব্যবহার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে খুব পুরনো। মেডিসিনাল উদ্ভিদ এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিন গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন মেডিসিনাল উদ্ভিদ রয়েছে। যেমনÑ সজিনা, পেঁয়াজ, গার্লিক ইত্যাদি হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ।

প্লানটেইন (চষধহঃধমড় ষহপবড়ষধঃধ খ.) একটি নতুন আবিষ্কৃত বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় মেডিসিনাল উদ্ভিদ। যা বিরূপ প্রভাব ছাড়াই পশুর শরীর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার কিংবা তার চেয়ে বেশি হারে বর্ধিত করবে। জাপান এবং চীন এ হার্ব নিয়ে গবেষণায় অনেকদূর এগিয়েছে। সাধারণ ঘাসের তুলনায় এর মধ্যে অধিক পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘ই’ আছে, যা স্কিনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এছাড়া এর মাঝে এমন কিছু বায়ো-অ্যাকটিভ উপাদান আছে যা সাধারণ ঘাসে নেই। এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবেও রয়েছে এর চমৎকার কার্যক্ষমতা। যা ফ্রি র‌্যাডিকেলের কার্যকারিতা বন্ধ করে প্রাণীদেহের কোষ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লানটেইন খাইয়ে উৎপাদিত মাংস কম চর্বিযুক্ত হয়, যা জাতির সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার। তাই মেধাবী ও সুস্থ জাতির জন্য পশুখাদ্যে মেডিসিনাল প্লান্ট ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী। সারা বিশ্ব এখন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে সোচ্চার। বিশ্ব এখন ঝুঁকছে অর্গানিক প্রোডাক্টের দিকে। অর্গানিক পদ্ধধিতে প্রাণিজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রাণিজ খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে ২০০৪ সালে জাপানের ইউয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন। তখন ওই দেশে এই ঘাসের উপর গবেষণা করে সফলতা পান তিনি। পেয়েছেন জাপানের সেরা তরুণ গবেষক, ডীন ও প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু উদ্ভিদটি শীতপ্রধান অঞ্চলের হওয়ায় মনে সুপ্ত আকাক্সক্ষা পোষণ করেন এটিকে কিভাবে দেশের প্রাণিজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজে লাগানো যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে পিএইচডি ও পোস্টডক শেষে বাংলাদেশে ফিরে উদ্ভিদটি নিয়ে দেশীয় আবহাওয়ায় জন্মানোর চেষ্টা করেন এবং সফলতা পান। শীতপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় তিনি শীতকালকে বেছে নেন তার গবেষণার উপযুক্ত সময় হিসেবে। এটি ৬-২৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তবে ২০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ঔষধি গুণাগুণ থাকে। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় দেশের কৃষকরা এটি ব্যবহার করলে খুব কম খরচেই অধিক লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।

ঘাসটির চাষাবাদ সম্পর্কে ড. আল-মামুন বলেন, নভেম্বরের শুরুতে বীজ ছিটিয়ে দিলে তেমন কোন যতœ নেওয়া ছাড়াই এটি যে কোন ধরণের মাটিতে জন্মায়। বীজ বপনের ৪৫-৫৫ দিন পর প্রথম কাটিং দেওয়া যায়। এর এক মাস পর দ্বিতীয় কাটিং এবং দ্বিতীয় কাটিং এর এক মাস পর তৃতীয় কাটিং দেওয়া যায়। তিনি এর উপকারিতা সম্পর্কে বলেন, রোমন্থক প্রাণী যেমন গরু, ভেড়া ইত্যাদিকে স্বাভাবিক খাবারের সাথে খুব সামান্য পরিমাণে (পোল্ট্রিতে ১%, ভেড়ায় ৪%, গরুতে ৫-১০%) ফ্রেশ প্লান্টেইন এবং এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর হিট স্ট্রেস কমিয়ে প্রোটিনের সিনথেসিস বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাংসের উৎপাদন, স্বাদ ও রং বৃদ্ধি পায় এবং পচনরোধ করে। এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দেয়। একই সাথে ফ্যাটি এসিডের (ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩) অনুপাত কমাতে সহায়তা করে। এতে করে মানুষের হার্ট ভালো থাকে। বয়স ধরে রাখতে সহায়তা করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল বাড়ায়। রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। ক্যান্সার ও অটিজম প্রতিরোধ করে। তাই অ্যানিমাল অ্যাক্ট যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প কিছু আবিষ্কার ও ব্যবহারে গবেষকদের সার্বিক সহযোগিতা করার দাবি জানান সরকারের কাছে। তার এ গবেষণাটি অ্যানিমাল জার্নালসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *