ড. সালমা লাইজু
ইদুঁর একটি চতুর, মেরুদন্ডী, স্তন্যপায়ী প্রাণী। আকৃতিতে ছোট হলেও এদের ক্ষতির ক্ষমতা খুবই ব্যাপক। যে কোন পরিবেশে টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা এদের অনেক বেশী। ইদুঁর গড়ে ৮-১০% ক্ষতি করে থাকে যার অর্থনৈতিক মূল্য অনেক। ইদুঁরের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে জাতীয়ভাবে ইদুঁর নিধন অভিযান বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতিবছর ৫ই অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী ইদুঁর নিধন অভিযান পালন করে থাকে।
পৃথিবীতে ১৭০০টি ইদুঁরের প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে ২০টি ক্ষতিকর প্রজাতি পাওয়া যায়। ইদুঁর শুধু মাঠ ফসলেরই ক্ষতি করে না, পোল্ট্রি শিল্পেও দারুন ক্ষতি করে। সেই সাথে ঘরের আসবাবপত্র, ইলেক্ট্রিক সামগ্রীসহ কাপড়চোপড়, কাগজপত্র সবকিছু নষ্ট করে। আবার প্লেগসহ প্রায় ৬০টি মারাত্মক রোগের জীবাণু বহন করে। ইদুরের আরেকটি খারাপ দিক হল যা খায় তার চেয়ে ৪-৫ গুন বেশী খাবার নষ্ট করে। ইদুঁরের মল-মূত্র এবং গায়ের পশমও মারাত্মক ক্ষতিকর। কোন খাবারের সাথে এগুলি মানুষের পেটে গেলে অনেক সমস্যা হতে পারে।
ইদুঁেরর গর্তের ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ বিনষ্ট হয়ে ফসলের মাঠ ও জনপদ তলিয়ে যায়, ফলে অপরিসীম ক্ষতি হয়ে থাকে। ইদুঁর অতি দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। অনুকূল পরিবেশে এক জোড়া ইদুঁর থেকে তিন হাজার ইদুঁর জন্ম নিতে পারে, যা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইদুঁর দমন পদ্ধতি মাঠ ফসলের রোগ এবং পোকামাকড় দমনের মত অত সহজ নয়। ইদুঁর খুবই চালাক এবং এবং স্মরণশক্তি খুবই তীক্ষè, তার যাতায়াতের পথকে সে দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারে। সুতরাং নতুন কোন জিনিষ (বিষ) দেখলেই সে খেয়ে ফেলবে এমনটি আশা করা ঠিক না। তার স্বজাতি কোন কিছু খেয়ে মারা গেলে ইদুঁর সেই জিনিষের ধারে কাছেও যাবে না। সুতরাং একক দমনের চেয়ে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইদুঁরের সংখ্যাকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে হবে যাতে সে বেশী ক্ষতি করতে না পারে। একক কোন পদ্ধতি যেমন কার্যকরী নয় তেমনি একা কোন ব্যাক্তির পক্ষেও ইদুঁর দমন করা সম্ভব নয়।
ইদুঁর আমাদের খাদ্য শৃংখলের একটি অংশ। ইদুঁরের উপর অনেক প্রাণি নির্ভরশীল। গুইসাপ, সাপ, বেজী, কুকুর, পেঁচা, বাজপাখি ইদুঁর খেয়ে থাকে। বর্তমানে এ সকল প্রানীর জীবন বিপন্ন প্রায়। গবেষণায় দেখা গেছে পেঁচা তার খাদ্য হিসাবে সবচেয়ে বেশী ইদুঁর খেয়ে থাকে। রাতে জমির ধারে বড় গাছে পেঁচা বসতে পারলে সহজেই সে জমির ইদুঁর ধরতে পারে। পেঁচা রাতে দেখতে পায় এবং সক্রিয় হয়। ইদুঁরও রাতে সক্রিয় হয়। শিকারের সন্ধানে পেঁচা ৩-৪ কিমি পর্যন্ত উড়তে পারে। পেঁচা সমস্ত ইদুঁরকে শেষ করে দিতেপারবে এমন নয়। বরং ইদুঁেরর সংখ্যা দারুনভাবে কমিয়ে দিতে পারবে যাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারন না হয় এবং প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে।
বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে ইদুঁরের উপদ্রব দারুণভাবে বেড়েছে, কৃষকরা ইদুঁর দমন করতে যেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে। অনেক সময় পথ চলতে দেখা যায় জমিতে লাঠির সঙ্গে প্লাষ্টিকের বড় বড় ফিতা বেঁধে রাখা হয়েছে যাতে এগুলি বাতাসে উড়ে এবং ইদুঁর ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এসব যথেষ্ট নয়, অনেক কৃষক হতাশ হয়ে বলে। ইদুঁর খেলে খাক আমার আর কিছু করার নাই।
বর্তমানকালে উন্নত জাতের খাটো ধরনের বৃক্ষের প্রচলন হয়েছে সেই সঙ্গে রাস্তার চারিদিকে আগের দিনে তাল, খেজুর গাছ এবং বিশাল আকৃতির বৃক্ষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। বাজপাখি, পেঁচা, চিল শকুন প্রভৃতি শিকারী পাখিদের আবাস স্থল দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আর এদের সংখ্যা নিম্মগামী, পরিবেশের জন্য এটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। জৈব বৈচিত্র রক্ষা করার জন্য এসব প্রাণিদের আবাসস্থল নিরাপদ করতে হবে। এছাড়া এদের সংখ্যা বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে গবেষণা করতে হবে। রাস্তার ধারে ইউক্যালিপটাস নয়, আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য তাল গাছ বেশী করে লাগাতে হবে। আমরা সারা বছরই জমিতে পার্চিং করে থাকি। এই সব জমিতে পার্চিং এর ডাল যদি মোটা ও শক্ত করে দেয়া হয় তাহলেও সেখানে পেঁচা বসবে এবং ইদুঁর খাবে। সুতরাং পার্চিং শুধুই ডাল পোতা নয়, পোকা মাকড় দমনের সাথে ইদুঁর দমনেরও একটি মাধ্যম হতে পারে।
ইদানিংকালে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিষ বের হয়েছে যার ফলে সবাই বিষ ব্যবহারে খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। কিন্তু একথা সত্য যে বিষ বিষই। বিষ ব্যবহারে রয়েছে নানা সতর্কতা তা কোন সময়েই মানা হচ্ছে না। বিষ দিয়ে মারা ইদুঁর যদি কোন মাংসাশী প্রাণি খেয়ে থাকে তাহলে তারাও বিষাক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। বিষাক্ত মৃত ইদুঁর গুলো সংগ্রহ করে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে, কিন্তু কে এই কাজ করবে।
আমাদের দেশে গ্রামের ঐতিহ্য ছিল বিভিন্ন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে টোপের সাহায্যে ইদুঁর মারা, সেগুলিকে আবার জনপ্রিয় করার কাজ করা যেতে পারে।
বসতবাড়ি ও এর আশেপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা, ইদুঁরের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পাতা যেমন গ্লু ট্র্যাপ, গ্লু-বোর্ড ইত্যাদি দিয়ে ইদুঁর ধরা, জীবন্ত ফাঁদ ব্যবহার করা, নিরাপদভাবে বিষ ব্যবহার করা, বিষ দিয়ে মারা ইদুঁরকে মাটিতে পুঁেত ফেলা, ইদুঁরের গর্তে ধোঁয়া দেয়া, পানি দেয়া অথবা ফসটক্সিন বড়ি দিয়ে ইদুঁরকে মেরে ফেলা, বিষটোপ ব্যবহার করা ইত্যাদি ইদুঁর দমনের বিভিন্ন কৌশল।
বিশ্বের অন্যতম ইদুঁর উপদ্রুত এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রনের এলাকা গুলো ইদুঁরের বংশ বিস্তারের জন্য অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় হাট বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে ইদুঁরের দাপট বেশী পরিলক্ষিত হয় (ইউএসডিএ, ২০১০)।
ইদুঁর ক্ষতিকর এতে কোন সন্দেহ নাই। আবার অনেক দেশে ইদুঁর জনপ্রিয় খাবার, বিশেষ করে চীনে ইদুঁর ফ্রাই এবং এর স্ন্যাক্স খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের সাওঁতাল সম্প্রদায় ইদুঁর পুড়িয়ে খেয়ে থাকে। এছাড়া ইদুঁরের উপর বিভিন্ন ঔষধের গবেষণা চলে। আবার অনেক প্রাণি ইদুঁরকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে।
ইদুঁর দমন করতে হবে, তবে তা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হবে এবং জৈব পদ্ধতি, যান্ত্রক পদ্ধতি এবং আমাদের গ্রাম বাংলার আবহমানকালের পদ্ধতিগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। কারন, সবার আগে পরিবেশ, রক্ষা করতে হবে জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম