কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিতে আমের উৎপাদন এবং আম রপ্তানির ভবিষৎ

আম রপ্তানি

আম রপ্তানিআম রপ্তানির সম্ভাবনা

 

 

 

 

 

 

 

ড. মোঃ শরফ উদ্দিনঃ

বাংলাদেশে উৎপাদিত ফল ও সবজির রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক। তবে সম্ভাবনার তুলনায় সফলতা যে খুব যে বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রপ্তানি সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তিবর্গ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্নভাবে তাদের প্রচেষ্ঠা অব্যহত রেখেছেন। কিন্তু এদের সুনির্দিষ্ট কোন কর্ম পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। রপ্তানির বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হর্ট্রেক্স ফাউন্ডেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ফল ও সবজি রপ্তানিকারক সমিতি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো যৌথভাবে সম্পন্ন করে থাকে। এদেশের বিভিন্ন ধরণের সবজি ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজির কিছু বৈশিষ্ট থাকা দরকার যা প্রচলিত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ সমুহে ফল ও সবজি আমদানিতে যে মানদন্ড নির্ধারণ করেছে তা যথাযথভাবে না মানতে পারলে ঐ সমস্ত দেশ এদেশে হতে ফল ও সবজি আমদানি করবে না। বাংলাদেশ হতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের সবজি বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। তবে ফলের রপ্তানি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব বেশি দুর অগ্রসর হতে পারিনি। এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, আমরা ক্রেতাদের শর্তসমুহ ঠিকমত ও যথাযথভাবে মানতে পারি না। এর সাথে রয়েছে আমাদের ভ্রান্ত ধারণাসমুহ। অনেকেই রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজি উৎপাদনের জন্য ফল ও সবজি চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত অথচ তার জানা নেই রপ্তানির জন্য প্রধান অন্তরায়গুলো কি কি? কি ব্যবস্থা নিলে এগুলোকে দুর করা সম্ভব। বরং পাঠ্যপুস্তক থেকে যত বেশি নেগেটিভ কারণ সংযোজন করে তাদের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলটি পাকাপোক্ত করে থাকেন। এগুলো পড়লে বা দেখলে একজন সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে এদেশের ফল ও সবজিগুলো ভবিষৎতেও রপ্তানি করা সম্ভব নয়। এই ধারণা থেকে সংশ্লিষ্ট চাষীরা নিরুৎসাহিত হন। বরং বাস্তবভিত্তিক ধ্যান-ধারণা থেকে বাস্তবায়নযোগ্য ম্যানুয়েল তেরী করতে হবে যা চাষীদের জন্য সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

আমার মনে হয় রপ্তানি বিষয়টিকে ততটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করে আমরা বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা গ্রহন করে থাকি। প্রত্যেকটি ফল ও সবজির একটি বৈশিষ্ট্য থাকবে, যা স্যানেটারী এবং ফাইটোস্যানেটরী মানদন্ড অনুসরণ করে উৎপাদন করতে হবে, সংগনিরোধ বালাইমুক্ত হতে হবে যেমন ফলের মাছি পোকা, থ্রিপস, সাদামাছি ইত্যাদি, উৎপাদন ও সংগ্রহ পর্যায়ে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ করতে হবে এবং ট্রেস্যাবিলিটির জন্য উৎপাদনের সকল পর্যায়ের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ সকল বিষয়গুলো সঠিকভাবে ও যথাযথ নিয়মে করতে হলে কন্ট্রাক্ট ফামিং বা চুক্তি ভিত্তিক ফসল চাষ এর বিকল্প নেই। আমরা আজকে জানবো আমের রপ্তানি ও কন্ট্রাক্ট ফামিং। আম রপ্তানি আম গবেষকদের কাছে অনেকটাই কঠিন কাজ ছিল তবে লক্ষ্য অর্জনে প্রচেষ্ঠাও ছিল। কিন্তু কখনও কাঙ্খিত শর্তসমুহ পুরণ করা সম্ভব হয়নি। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে হর্টেক্স ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের জুন মাসে কিছু বারি আম-২ আম ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাঠানো হয়েছিল। আমগুলো পাওয়ার পর তা সাদরে গ্রহন করেছিল এবং জুলাইমাসে এক ফ্যাক্স বার্তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে জানানো হয় যে পাঠানো আমগুলো তাদের পছন্দ হয়েছে এবং বাংলাদেশের এই আমটি তারা নিতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে বারি আম-২ এর মৌসুম শেষ। আর মৌসুম থাকলেও বা কি ! এক টন আমের চাহিদা মেটাতে ১০ টনের মতো আম প্রয়োজন হতো। এরপর চলতে থাকে আরও গবেষণা। একবার কিছু কৃষি বিজ্ঞানিকে দক্ষ প্রশিক্ষক গড়ে তোলা হলো এবং ২০১৫ সালে তাদের মাধ্যমে আমচাষীদেরকে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। সকলে আশা ছিল এইবার হয়ত বেশকিছু আম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু ঘটলো তার উল্টোটা । আম সুন্দর হওয়া তো দুরের কথা, অত্যধিক বৃষ্টির কারণে আমের রং ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এবং আমের মাছি পোকা দমন করা অনেকটাই কঠিন হয়েছিল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। দক্ষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে আমচাষীদের প্রশিক্ষিত করেও আম রপ্তানি সম্ভব হয়নি। সংশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ধারনাও ছিলনা অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে আমগুলো কিভাবে সুন্দুর থাকবে, আমের মাছি পোকা কিভাবে শতভাগ দমন করা যাবে। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, পরিকল্পনা যদি সঠিক না হয় তাহলে লক্ষ্য অর্জন অনেকটাই কঠিন। অথচ ২০১৫ সালের আমের মৌসুমে ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ল্যাড়া ও ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে বিদেশে রপ্তানি হয়। এরপরের মৌসুমে অর্থাৎ ২০১৬ সালে সারাদেশ হতে প্রায় ৩০০ টনের মতো আম ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানী, সুইডেন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে পৃথিবীর প্রধান আম রপ্তানিকারক দেশে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে আম উৎপাদন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় এই আমগুলো শতভাগ রপ্তানি উপযোগি। তাহলে আমরা কেন ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছি না। গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমানিত হয়েছে যে, ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি একটি পরিবেশ বান্ধব, সাশ্রয়ী ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের সহজ উপায়। কন্ট্রান্ট ফামিং ধারনাটি যদিও রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজি উৎপাদনে একটি কার্যকরী ও ফলপ্রসু পদক্ষেপ তথাপিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কর্মতৎপরতা ততটা সন্তোষজনক নয়। আমি বুঝি না এটা কি তারা নিজেরাও ভালোভাবে বোঝেন কিনা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বিগত মৌসুমগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, আমের ক্ষেত্রে কন্ট্রান্ট ফামিং নিয়ে কৃষকের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আসেন জানুয়ারী-ফেব্র“য়ারী মাসের দিকে। য়খন কিনা বাগান ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ন অংশসমুহ সম্পন্ন হয়ে যায়। এরপর এক শ্রেনীর ব্যক্তিবর্গ শুধুই ভুল খুজে পান আমচাষীদের কিন্তু শোধরানোর কোন পথ তাদের জানা নায়। আসলে এই দোষ কি আমচাষীদের? কন্ট্রান্ট ফামিং এর ধারণা থেকে বুঝা যায়, ফল বা সবজি উৎপাদনের শুরু থেকে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত চাষীদেরকে প্রথমেই ধারণা দেওয়া হবে। এরপর চাষীরা সে নিয়মনীতি গুলো সঠিকভাবে মেনে চলার চেষ্ঠা করবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উৎপাদনের বিভিন্ন সময় মনিটরিং করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর উল্টোটা। আমরা বেশিরভাগ সময়েই মনিটরিং নিয়ে ব্যস্ত থাকি যেটি মোটেই কাম্য নয়। প্রথম বারের মতো কন্ট্রান্ট ফামিং এর মাধ্যমে উৎপাদিত আম বিদেশের বাজারে রপ্তানি করা হয়। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রায় শতভাগ ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত আম রপ্তানি হয়। প্রথমে রপ্তানিকারকদের চাহিদা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানানো হয়, পরে চুক্তিভিত্তিক চাষীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে আমগুলো নিয়ে আসা হয়। পরে সেখান খেকে সর্টিং, গ্রেডিং শেষে মনোরম প্যাকেটে প্যাকিং করা হয়। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখো যায়, এদশের আমের কোন আধুনিক প্যাকিং হাউজ নেই। যে সকল জায়গায় বেশি পরিমানে গুনগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদিত হয় সে সকল স্থানে প্যাকিং হাউজ নির্মান অত্যন্ত জরুরী মনে আমি মনে করি। আশাকরি, রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিবেন যার ফলাফল আমরা আগমী মৌসুমে দেখতে পাবো। সুতরাং কন্ট্রান্ট ফার্মিং এর চাষীরা আম উৎপাদনের উত্তম ফসল ব্যবস্থাপনার (প্র“নিং, ট্রেনিং, সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বান্ধব বালাই ব্যবস্থাপনা) সাথে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করতে পারবেন।
একটি কথা মনে রাখতে হবে রপ্তানি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়, কারও কোন অসাধু তৎপরতাই যেন এটি বন্ধ না হয় সেই বিষয়ে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে। তবেই আমাদের দেশের আম রপ্তানির ধারা অব্যহত থাকবে।


ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাই নবাবগঞ্জ

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *