লাভজনক খামার করার লক্ষ্যে গবাদি পশুর উকুন ও তার প্রতিকার

গবাদি পশুর উকুন

গবাদি পশুর উকুন
মুনিরুজ্জামান
আমরা আমাদের প্রয়োজনে খাদ্য যোগানোর জন্য কৃষিকাজ করি। অতিরিক্ত আয় বা ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য কিংবা পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্যই হওক কম বেশি পশু পাখি লালন-পালন করি। আমাদের অধীনে এসব অবলা জীব থাকার কারণে এদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। এদের জন্ম, বৃদ্ধি, দুধ,ডিম, মাংস সব কিছু কেবল আমাদের জন্য। এদের প্রতি যত্ববান হলে এরা ভাল ফল উপহার দেয় নচেত নয়।

যারা নাকি পরের খেয়ে পরে মানুষ হয় তাদের বলা হয় পরজীবী। সে দিক থেকে বিচার করলে আমরা একপ্রকারের পরজীবী। আবার আমাদের চারপাশে আমদের সাথে বাস করছে খালি চোখে দেখা না যাওয়া অনেক পরজীবী। যারা উদ্ভিদ মানুষ সহ সকল প্রাণী কুলের উপর নির্ভরশীল। এই পরজীবী আর আমাদের মধ্য পার্থক্য হচ্ছে আমরা পরিশ্রম করে খাদ্য উৎপাদ করে খায় আর এগুলো শুধু খেতে যা পরিশ্রম করে। যার ফলে আমদের খেয়ালে বেখেয়ালে এর আমাদের উৎপাদন হ্রাস করে নানা রোগ সৃষ্টি করে আমাদের অর্থনীতির ব্যপক ক্ষতি সাধন করে। ক্ষতিকর পরজীবী গুলোর মাঝে উকুন হলো গুরুত্ব পূর্ণ পরজীবী।

আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া ও মুরগি শীতকালের শেষের দিকে উকুন দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রাণীর তলপেট, কান, গলকম্বল, লেজের মাথা, থুতনির নীচে, পায়ের কুঁকচির মধ্যে উকুনের সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়। বয়স্ক প্রাণী অপেক্ষা অল্প বয়স্ক প্রাণী এদের দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
তাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গবাদি পশু বা আমাদের গৃহপালিত পশু যেমন গরু-মহিষ ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি প্রজাতির উকুন। এর ক্ষরিকর প্রভাব এবং এ থেকে পরিত্রান পাওয়ার উপায়।

উকুন বলতে যা বুঝায়ঃ
উকুন  (থাইর‌্যাপটেরা) পর্বের, এক প্রকারের পাখনা বিহীন পরজীবী যারা প্রাণীর শরীর থেকে পুষ্টি গ্রহন করে পরক্ষ ভবাবে দেহের ক্ষতি সাধন করে। উকুন (খড়ঁংব)মানুষসহ বিভিন্ন স্তন্যপাযী ও পাখির ক্ষুদ্র ডানাবিহীন বহিঃপরজীবী। প্রতিটি প্রাণীর জন্য উকুনের প্রজাতি ভিন্ন অর্থাৎ গরুর উকুন কখনই মুরগিকে আক্রমণ করে না।উভয ধরনের উকুনের দেহ পৃষ্ঠীয-অঙ্কীযভাগ বরাবর চ্যাপটা, দৈর্ঘ্যে মাত্র ২-৩ মিমি; পা খাটো, নখরবিশিষ্ট এবং লোম অথবা পালকের মধ্য দিযে দ্রুত দৌড়াবার জন্য অভিযোজিত। অপরিণত উকুন বা নিম্ফ এর চেহারা ও স্বভাব পরিণত বযসের উকুনের মতোই।

উকুনের প্রকারভেদ করতে গেলে দুই প্রকারের উকুন পাওয়া যায়:
যথাঃ-
(ক) শোষক উকুন: এগুলো কামড়ায় ও রক্ত শোষণ করে।শোষণক্ষম উকুনদের মুখোপাঙ্গ পোষকের ত্বক ছিদ্র করার এবং রক্ত শোষণের উপযোগী। এদের বক্ষ এলাকার দেহ খন্ডগুলি একীভূত এবং মাথা বক্ষের চেযে সরু।
(খ) দংশনকারী উকুন: যারা শুধু কামড়ায় ।মুখোপাঙ্গ শোষণের উপযোগী না হওযার কারণে এরা পোষক দেহ থেকে সরাসরি কখনও রক্ত শোষণ করে না। ত্বকোদ্ভূত বস্তÍ, লোম ও পালকের অংশ ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
গবাদি পশুর উকুনঃ
বাংলাদেশে যেসব উকুন গবাদি পশুকে আক্রমণ করে তার মধ্যে গরুর উকুন Bovicola bovis ; Haematopinus erysternus  ;  , ঘোডার উকুন H. asini  এবং শুকরের উকুন H. suis  উল্লেখযোগ্য। খরহড়মহধঃযঁং -এর কযকেটি প্রজাতি গরু, ভেডা, ছাগল, এবং কুকুরকে আক্রমণ করে। মানুষ এবং গবাদি পশু ছাডাও অনেক উকুন প্রজাতি বণ্যপ্রাণীর দেহে পরজীবী।

মানুষের উকুনঃ
মানুষের পরজীবী উকুন Pediculidae গোত্রের Pediculus Ges Phthirus-এর সদস্যরা উভয গণ বিশ্বের সর্বত্র বিস্তৃত।  বাংলাদেশে মাথার উকুনের উপস্থিতি এক মামুলি ব্যাপার। গ্রাম বাংলার শতকরা প্রায ১০০ ভাগ ছেলেমেযে ও স্ত্রীলোক এবং শহরের বস্তি এলাকায বসবাসকারী বহু লোকজনের মাথায উকুন বাস করে।
যে ভাবে ছড়ায়ঃ
 উকুন বা বহিঃপরজীবীরা প্রধানত সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে ছোডয়া।
 ছোট বাচ্চা বা বাছুরেরা তাদের মাযেেদর এবং সহচরদের আক্রান্তদের মধ্য থেকে উকুন দ্বারা আক্রান্ত হয়।
জীবণ চক্রঃ
উকুন প্রায় সারাবছরেই পশুর শরীরে থাকতে পারে। প্রাপ্তবযস্ক স্ত্রী উকুন ডিম পেড়ে পোষকের দেহে ললোমের সাথে লাগিয়ে রাখে। যা থেকে – দিনের মধ্যে বাচ্চা বা নিম্ফ (ডিম থেকে বেড় হওয়া সদ্যজাত বাচ্চাকে নিম্ফ বলা হয়) বেড়িয়ে আসে। তারা প্রাপ্তবযস্কদের অনুরূপ, কিন্তু ছোট চেহারা, এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি ধাপের মধ্য দিযে প্রায দিনের মধ্যে ডিম-পাডার উপযুক্ত হয়।
ক্ষতিকর প্রভাবঃ-
 সংখ্যায পর্যাপ্ত হওয়ায় উকুন পোষকদেহে এক বিরক্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে এবং কিছু কিছু প্রজাতি বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটায।
 এরা সরাসরি পোষকের দেহের রক্ত চুষে খায়। ফলে প্রাণী রক্তশূন্য হয়ে পড়ে এবং সকল প্রকার উৎপাদন হ্রাস পায়।
 উকুন, আঁঠালী, মশা ও মাছি দংশন করার সময় প্রাণী অস্থির ও অস্বস্তি বোধ করে। ফলে পেট ভরে খেতে পারে না; এতে করে উৎপাদন কমে যায়।
 উকুনর কামড়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রাণী বিভিন্ন বস্তুর সাথে শরীর ঘষাঘষি করে; ফলে চামড়া ও লোম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
 উকুনের কামড়ের কারণে প্রাণীর চামড়ায় চুলকানী এবং এলার্জির সৃষ্টি হতে পারে।
 শীতকালের নবজাত বাছুর, ছাগল ছানা অতিরিক্ত উকুন ও আঁঠালী দ্বারা আক্রান্ত হলে রক্ত স্বল্পতার কারণে মারাও যেতে পারে।
কিছু বহিঃপরজীবী ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগের বাহক হিসাবে করে থাকে যেমন
ক) ব্লুটাং
খ) আফ্রিকান হর্স সিকনেস
গ) ইপিজুটিক হিমোরেজিক ডিজিজ
ঘ) আকাবানে ডিজিজ
ঙ) বোভাইন ইফিমেরাল ফিভার, ইত্যাদি
কিছু বহিঃপরজীবী অন্তঃপরজীবীর বাহক হিসাবে কাজ করে থাকে যেমন-
ক) হিমোপ্রোটিয়াস
(খ) লিউকোসাইটেজুন
(গ) অনকোসারকা
(ঘ) মানসোনেলা, প্রভৃতি
লক্ষণঃ
 অল্প সংখ্যক উকুনের আক্রমনে পোষকের তেমন কোন উপসর্গ প্রকাশ পায় না।
 মাঝারী আকারের আক্রমণে দীর্ঘ মেয়াদী চর্মপ্রদাহ হয়।
 তীব্র আক্রমণে প্রাণীর চুলকান হয়। ফলে জিহ্বা দিয়ে চাটে ও শক্ত বস্তুর সাথে শরীর ঘষা দেয়।
 পশু দুর্বল হয়ে পড়ে এনিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়।
 পশুর ওজন কমে যায়
 দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়।
 বাছুরের লোম পড়ে যায়।
সনাক্ত করণঃ
 পশুর ত্বক ও লোমে উকুন ও উকুনের ডিম খালি চোখে দেখা সনাক্ত করা যায়।
 তাছাড়া প্রজাতি সনাক্ত করার জন্য স্লাইড মাউন্ট তৈরি করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করতে হয়।

চিকিৎসা ও প্রতিকারঃ
কীটত্তত্ববীদ অধ্যাপক জ্যাক ক্যাম্পবেল বলছেন-
 গবাদি পশুর শীতকালীন চামড়া কোট উকুন সুরক্ষা ও প্রজননের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ প্রদান করে, এরা জীবনচক্রের – দিন এবং সমগ্র চক্র পোষক এর দেহে কাটায়। তাই এ সময় এদের নিধন সহজ হয়। ক্যাম্পবেল ব্যাখ্যা করেন যে, প্রাপ্তবযস্ক উকুন পোষোক থেকে খুব দীর্ঘ সময় পৃথক্ থাকতে পারে না। কিংবা ডিমও ঠান্ডা আবহাওযার মধ্যে দীর্ঘ সময় থাকলে তা থেকে বাচ্চা বের হয় না।
 আর আমরা যদি নিয়মিত গবাদি পশুগুলো কে গোসল করায় তাহলে উকুন সহ অন্যান্য বহিঃপ্রজীবী থেকে রক্ষা করা যাবে।
 সামান্য সংখ্যক আক্রমণে গরুকে রোদে বেধে দিলে অনেকাংশ উকুনের পরিমাণ কমে যায়।
 উকুনের চিকিৎসায় লিন্ডেন-০০৫, ম্যালাথিন-০৫, টক্সোফেন-০৫ পশুর শরীরে ব্রাশ দিয়ে লাগালে অথবা স্প্রে করলে ভালফল পাওয়া যায়।
 ফোক্সিম ১২৫ মিলিগ্রাম/ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে উকুন সক্রমণ ঠেকানো যায়।
 আইভারমেকটিনো উকুনের চিকিৎসায় ইদানিং ব্যবহার করা হচ্ছে।
 আরও কিছু ঔষধ যেমন নিওসিডাল, অ্যাসান্টোল, নেগুভোন, বুটেক্স ইত্যাদি কোম্পানির র্নিদেশনামত ব্যবহার করা যায়।
——

লেখক পরিচিতি
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
ভেটেরিনারি এন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *