গবাদিপশুর নাইট্রেট বিষক্রিয়া কারণ ও প্রতিকার

নাইট্রেট বিষক্রিয়া

 

গবাদি পশুর বিষক্রিয়া

মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান,

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। নানান সময় নানান রুপে রঙ্গিন হয় এই দেশ। অনান্য দেশের  তুলনায় একটা জনবহূল দেশ বাংলাদেশ। এদেশের আমিষের চাহিদা পুরণ করার জন্য লালন পালন করা হয় গবাদিপশু সহ পোল্ট্রিকে।বাংলাদেশের প্রতিবছর বহুসংখ্যক প্রাণি মারা যায় শুধুমাত্র নাইট্রেট বিষক্রিয়ার কারণে।

বাংলাদেশে কৃষি প্রধান দেশ। এই দেশে মানুষ বহুমখি কাজে তেমন পারদর্শী না হলে বর্তমানে একসাথে অনেক কিছু করার চেষ্টা করছেন। যাদের জমি আছে , যারা চাষবাদ করেন তারা কিছুনা কিছু গরু ছাগল ও পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রে অনেক জায়গায় গরুকে মাঠে চড়ানোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা যায়, সকালে গরু মাঠে চড়তে গিয়ে সন্ধায় আনতে গেলে দেখা যায় মরে পড়ে আছে। অনেক সময় এই সমস্যা হয় বিষক্রিয়ার মাধ্যমে, যে সমস্ত বিষক্রিয়া  বেশি হয় তার মধ্যে নাইট্রেট পয়জনিং অন্যতম।

দীর্ঘ প্রচণ্ড খরার পর হঠাৎ একদিন হয় প্রশান্তির একপশলা বৃষ্টি। প্রাণ ফিরে পায় গাছা পালা , প্রাণিকূল। চৌচির হওয়া মাঠে নতুন করে গজায় ঘাস। খুব সুন্দর হয়ে বড় হয় ঘাসগুলো। মজাদার ঘাস পেয়ে গরুরা ইচ্ছামত খায়, তখনই এই সমস্যা  বেশি হয়ে থাকে।

রোগ পরিচিতিঃ এটা একটি বিষক্রিয়া যা নাইট্রেট যুক্ত খাবার খেয়ে বেশি হয়। সাধারণত বৃষ্টির পরে গজানো কচি ঘাসের মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমান বেশি থাকে।

নাইট্রেটের পরিমানের উপর এই বিষক্রিয়া নির্ভর করে , এই নাইট্রেট এমনিতে তেমন বিষাক্ত যদি তার পরিমাণ ঠিক থাকে।

বিবেচ্য ফ্যাক্টোরঃ

  • নাইট্রেটের পরিমান যদি অতিরিক্ত পরিমানে অথবা খুব ঘন ঘন বেশি পরিমান যদি প্রাণির পেটে যায়।
  • নাইট্রেটের পরিমান এবং রুমেনে উপস্থিত মাইক্রোফ্লোরার(উপকারী অণুজীব) উপস্থিতির উপর রোগের মাত্রা নির্ভর করে।
  • রুমেন মাইক্রোফ্লোরা এই নাইট্রেট কে নাইট্রাইট এবং পরে রিডাকটেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে নাইট্রাইটকে আমোনিয়া ও প্রোটিনে পরিনত করে। কিন্তু যদি রক্তে তা অতিরিক্ত পরিমান উপস্থিত থাকে তাহলে বিষক্রিয়া প্রদর্শিত হয়।
  • শুধু মাত্রার উপরই নয় প্রাণির দেহের অবস্থার উপর ও এর মাত্রা নির্ভর করে। অনেক সময় বেশি পরিমানে একবারে খায়, অথবা অল্প অল্প করে অনেক বারে খায় তাহলে এর বিষক্রিয়া অনেক বেশি হয়ে যায়।
  • খালি পেটে অল্প পরিমান খেলেও অনেক সময় বিষক্রিয়া প্রদর্শিত হয়।

নাইট্রেটের উৎস কী কীঃ

  • আমাদের আশেপাশে অনেক গাছ বা ঘাস পাওয়া যায় যা বেশি পরিমানে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে থাকে।
  • কৃষি জমিতে অতিরিক্ত পরিমানে ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে সে জমিতে ঘাস বা ফসল জন্মালে তাতে নাইট্রোজেনের পরিমান বেশি থাকে। আর প্রাণি অতিরিক্ত পরিমানে তা খেলে আক্রান্ত হতে পারে।
  •  শ্যামা, হেলেঞ্চা, বোরো, ধনচা, রাই ঘাস ইত্যাদি ঘাসের মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি

যেভাবে বিষক্রিয়া হয়ঃ

নাইট্রেট এবং নাইট্রাইট পানিতে দ্রবনীয়। তাই পানিতে নাইট্রেট এবং নাইট্রাইট থাকে নাইট্রোজেন হিসেবে।

নাইট্রেট এর চেয়ে নাইট্রাইট ৬-৭  গুন বেশি বিষাক্ত। নাইট্রাইট রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে বিক্রিয়া করে মিথোহিমোগ্লোবিন তৈরি করে। যা রক্তের স্বাভাবিক কাজ সম্পর্ন করতে পারেনা, এটা অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে এই বীষাক্ত উপাদান বেশি হয়ে  প্রাণি অক্সিজেনের অভাবে এবং বিষক্রিয়ার প্রভাবে শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এমনি মারাও যায়।

যখন বেশি হয়ঃ এই সমস্যা প্রধানত প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টির ফলে গজানো ঘাস থেকে বেশি হয়। বছরের মাসের হিসেব করলে তা হয় মে- জুলাই মাসের মধ্যে। যারা মাঠের মধ্যে গরুকে খোলা চরায় তাদের গরুতে এই সমস্যা বেশি লক্ষণীয়।

বিষক্রিয়ার সাথে জড়িত বিষয়াবলীঃ শুধু নাইট্রেট পয়জনিং এ নয় বরং সকল পয়জনিং এ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল-

১। প্রাণির দৈহিক অবস্থাঃ সাধারণত স্বাস্থ্যবাণ গরুতে সহজে রোগ বা বিষ ক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রুগ্ন ও হাড্ডিসার গরুর চেয়ে কম। এদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে।

২। বিষের মাত্রাঃ অল্প অল্প করে বিষখেলে অনেক সময় তা প্রাণি দেহে তেমন ক্ষতি করেনা বরং তাতে গরুর তার উপর প্রতিরোধ ক্ষমত তৈরি হয়, কিন্তু তা সবক্ষেত্রে হয়না। তাই না খাওয়ানোই উত্তম। আর মাত্রা যদি  বেশি হয়ে যায় তবে তা সহজে প্রাণির ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত গরুতে নাইট্রেট ৪০৯-৭৫০ মিলিগ্রাম প্রতিকেজি ওজন হারে হলে মৃত্যু ঘটাতে পারে।

৩। খাওয়ার সময়ঃ যদি খালি পেটে খায় তাহলে দ্রুত বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

লক্ষণ সমুহঃ অনান্য বিষক্রিয়ার মত এই রোগেও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। সাধারণত খাওয়ার মাত্রার উপর এই লক্ষণের কম বেশি দেখা যায়-

  • শ্বাস কষ্ট এবং বার বার হাপিয়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা।
  • খুব দ্রুত শ্বাস প্রাশ্বাস নেয়াও।
  • লালা ঝরে।
  • পাতলা পায়খানা।
  • নীল রঙের মিউকাস মেমব্রেন দেখা যায়।
  • প্রসাবের কোন রঙ থাকেনা।
  • নাইট্রেট রক্ত নালীর প্রসারতা বাড়িয়ে রক্তের চাপ() কমিয়ে দেয়
  • খাওয়া বন্ধ করে দেয়, খোড়াতে থাকে এবং মাত্রা বেশি হলে ২- ২৪ ঘন্ঠার মধ্যে মারা যেতে পারে।

মৃত পশুর ময়না তদন্তঃ

  • গাঢ় চকলেট বাদামী বা কফির রঙ এর মত রক্ত পাওয়া যায় যা তেমন জমাট বাধেনা।
  • টিসু গুলো বাদামী রঙ ধারণ করে।

চিকিৎসাঃ এই রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার মুল উদ্দেশ্য হলো রক্তে মিথোহিমোগ্লবিন এর পরিমান কমিয়ে দেয়া। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল কাজ করে মিথাইলিন ব্লু ১% সল্যুশন করে ৮.৮ মিলিগ্রাম হিসেবে আস্তে আস্তে শিরা পথে দিতে হবে।

  • মিথসিলিন ব্লু ২০-৩০ মিনিট পর পর দিতে হবে যদি ভাল ফলাফল পাওয়া না যায়। কারন এর কার্যকারিতা ২ ঘন্ঠা স্থায়ি থাকে। তাই ২ ঘন্ঠা পরে প্রয়োজনে আবার দেয়া যায়।
  • অতিরিক্ত চিকিৎসা হিসেবে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ, এন্টিবায়োটিক দেয়া যাবে।
  • প্রয়োজনে রক্ত দিতে হবে।

প্রতিরোধঃ কথায় আছে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই প্রাণির সংস্পর্শ থেকে এসব নাইট্রেটের উৎস সরাতে হবে।

  • জমিতে বেশি সার বা বিষ প্রয়োগের পরিবর্তে বিকল্প স্বাভাবিক ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গরুকে মাঠের মধ্যে ছেড়ে চড়ানোর ব্যপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
  • শুধু ঘাস বেশি না খাওয়ায় ভাল।
  • সার বেশি দেয়া জমির ঘাস অল্প পরিমানে খাওয়াতে হবে।
  • রোগের মৈসুমে গরুকে সচেতন ভাবে লালন পালন করতে হবে।
  • খামারীদের সচেতন থেকে এর প্রভাব কমাতে হবে।

উপরক্ত বিষয়গুলো লক্ষ করে গরু পালন করলে সহজেই এই সকল ঘাতক রোগ হতে মুক্ত থাকা যাবে। যা খামারির লাভ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের অগ্রগতিতেও অংশ নেয়া হবে । আপনার গরু সুস্থ্য থাকুন সুন্দর থাকুক এটাই আমাদের কাম্য।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *