কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন,ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি।
প্রকৃতি ক্রমশ বিরূপ আকার ধারন করছে। ক্রমপরিবর্তনশীল প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন ফসলের জাত উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য।
দেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৭৩টি ইনব্রিড ও চারটি হাইব্রিডসহ মোট ৭৭টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন যার মধ্যে রয়েছে ৮টি লবণাক্ততা সহনশীল, ৫টি খরা সহিষ্ণু, ২টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, ২টি ঠান্ডা সহনশীল, পাঁচটি সরু ও সুগন্ধি এবং ৪টি জিংক সমৃদ্ধ ধানের জাত। সাম্প্রতিক সময়ে ইরি’র বিজ্ঞানীদের ধানের জিন বিন্যাস উম্মোচন বা জেনোম সিকোয়েন্স উম্মোচন দেশের ধান গবেষণার এই সাফল্যে নতুনমাত্রা যোগ করবে।
আলোচিত খবরটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ইরি’র এর বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮৯টি দেশের প্রায় তিন হাজার প্রজাতির ধানের জিন বিন্যাস উম্মোচন বা জেনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন ও উম্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। যা গেল মাসে সবার জন্য উম্মুক্ত করা হয়। আশার কথা এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ১৮৩টি ধানের জাত। শীঘ্রই কৃষকরা ধানের জিনোম সিকোয়েন্স প্রযুক্তির সুবিধা হাতে পাবেন বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণকারী শস্যটির বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে একটি সবুজ বিপ্লবের দুয়ার খুলে দিতে পারে এই আবিষ্কার। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এটি ধান উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
জীববিজ্ঞানে জীবের জিনোম (ইংরেজি: এবহড়সব) বলতে সমস্ত বংশগতিক তথ্যের সমষ্টিকে বোঝায়, যা সেটির ডিএনএ’তে সংকেতাবদ্ধ থাকে। জিনোমে জিন এবং জাংক ডিএনএ দুই-ই থাকে। ১৯২০ সালে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হান্স ভিংক্লার জিন ও ক্রোমোজোম শব্দ দুইটির অংশবিশেষ জিনোম শব্দটি উদ্ভাবন করেন। জেনোম সিকোয়েন্স হলো কোষের সম্পুর্ন ডিএনএ বিন্যাসের ক্রম। জিনোম যত দীর্ঘ হবে, তার ধারন করা তথ্যের পরিমানও তত বেশি হবে। জীব দেহে বহুসংখ্যক কোষ থাকে। প্রতিটি কোষ সেই জীবের বিকাশ এবং গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বহন করে। এই সকল নির্দেশনার সমন্বয়ই হলো জিনোম যা ডিএনএ কিংবা আরএনএ দিয়ে গঠিত।
ধান বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রযুক্তি ছাড়া যেখানে একটি জাত উদ্ভাবন করতে ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লাগত সেখানে এই তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই কৃষকদের হাতে উন্নত প্রজাতির ধান পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। আর এ কারণেই প্রকল্পটিতে কর্মরত বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এ ঘটনা দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের এর সূচনা করবে।
প্রথমদিকে ভিন্ন ভিন্ন চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধানের ফলন বাড়ানো হত। গত শতাব্দিতে উচ্চ ফলনশীল বা অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ধানের বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা করে ‘ক্রস ব্রিডিং’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। তবে কোন জিনগুলো এ বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে তা আগে জানা যায়নি, তাই সঠিক বৈশিষ্ট্য অনুমান করতে গিয়েই অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় হত। বর্তমানে মোলিক্যুলার জেনেটিক্স এর কল্যাণে কোন জিন কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে তা দ্রুতই জানা সম্ভব ।
এছাড়া বর্তমানে প্রতিকুল পরিবেশ সহনশীল জাত উদ্ভাবনের জন্য কৃত্রিমভাবে প্রতিকুল পরিবেশ তৈরী করে সেখানে একটি নিদিষ্ট জাতের সহনশীলতা যাচাই করা হয় যা একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এই সময় সাপেক্ষ ব্যাপারটি আরো সংক্ষিপ্ত সময়ে করাই ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) বিজ্ঞানীদের তিন হাজারের বেশি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ধানের ডিএনএ বা জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করার মূখ্য উদ্দেশ্য। যাতে আর্থিক সহায়তা করেছে চায়নিজ একাডেমী অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, চায়নিজ মিনিস্ট্রি অব সায়েন্স এবং বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এই প্রকল্পের দাতারাও মনে করেন, এত ব্যাপক পরিমাণে তথ্য উন্মোচিত হওয়ায় প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল উচ্চ ফলনশীল প্রজাতির ধান চাষ শুরু করা যাবে। এখন ধান চাষীরা আরও দ্রুত উৎপাদন পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার শুরু করতে পারবেন। এছাড়াও নির্দিষ্ট পোকামাকড় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন প্রজাতিও আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, এই বিস্তারিত ডিএনএ তথ্য হাতে পাওয়ায়।
শুধু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান আহার নয়, ধান থেকে পাওয়া চালকে প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে বেঁচে থাকে বিশ্বের অর্থেক মানুষ। বিশ্বের শতকরা ৬০ভাগ লোকের প্রধান খাবার চাল বা চাল থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন পণ্য। আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রধান খাদ্য ভাত। বিশ্বের ৯০ভাগ ধান উৎপাদন ও ব্যাবহার হয়ে থাকে এশিয়া অঞ্চলে। একারণে বলা হয়, রাইস ইজ লাইফ ইন এশিয়া। গবেষণা বলছে, বিশ্বের ১৬ কোটি হেক্টর ধানি জমিতে বর্তমানে চাল উৎপাদন হয় ৪৭ কোটি টন। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের যে জনসংখ্যা হবে তার চাহিদা পূরণ করতে লাগবে আরো ২৫ ভাগ বাড়তি উৎপাদন। কিন্তু প্রতিনিয়ত কমছে চাষের জমি। আর জলবায়ুর পরিবর্তনের অভিঘাত তো আছেই। তাহলে উপায় কী? এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এর বিজ্ঞানী ও প্রাণরসায়নবিদ ড. কেনেথ ম্যাকক্যালি মনে করেন, ডিএনএ বা জেনোম সিকোয়েন্স এর মতো প্রযুক্তি যেসব দেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত তাদের জন্য বড় ধরনের সাফল্য বয়ে আনবে।
ইরি’র জেনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবক দলের সদস্য ও রাশিয়ান বিজ্ঞানী নিকোলাই আলেকসানড্রাইভ বলছেন, এই আবিস্কারের মাধ্যমে শস্যে মানুষের শরীরের চাহিদামাফিক বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সংযোজন বা বায়োফর্টিফিকেশন করা অধিকতর সহজ হবে। এছাড়া এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ, পোকা-মাকড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও ঠান্ডা সহনশীল জাত উদ্ভাবন আরো ত্বরান্নিত হবে। তবে ধানের জিন বিন্যাসকে কাজে লাগানোর কোন প্রযুক্তি দেশে না থাকায় গবেষকরা নতুন জাত আবিস্কারে জীবন রহস্যকে কাজে লাগাতে পারছেন না।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এর বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিএনএ বা জেনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন যদিও বিশ্বব্যাপি ধান উৎপাদক দেশসমূহে ব্যাপক আশা জাগিয়েছে তথাপি তারা এটিকে ধান উৎপাদনের সব সমস্যার সমাধানের ম্যাজিক মনে করছেন না। তাদের মতে, এই বিষয়ে আরো বিস্তর গবেষণা ও অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে।
কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com