আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ *
পাটিগাছের সাথে পরিচয়
পাটিগাছ দেখতে নলের মতো হলেও এ গাছ নলের মতো শক্ত ও লম্বা হয় না। পাতাগুলো হলুদের পাতার মতো কিন্তু আরও ছোট। পাটিগাছ চিনতে হলে পাটিগাছের মোথা, কাণ্ড, শাখা, পাতা, ফুল ও ফল কেমন তা জানতে হয়। মাটির নিচে পাটিগাছের শিকড়যুক্ত অংশকে মোথা বলে। মাটির উপরে ৩ থেকে ৫ হাত লম্বা গিটহীন নলের মতো সবুজ দণ্ডকে কাণ্ড বলা হয়। কাণ্ড থেকে বেতি তুলে শীতলপাটি বুননের কাজে লাগানো হয়। পাটিগাছের গিটহীন কাণ্ড শেষ হলে মাথার দিকে অবস্থিত গিঁট থেকে একটু মোটা হয়ে শাখা বা ডাল গজায়। শাখা লম্বায় ছোট ও সরু। পাটিগাছের শাখা থেকে একটি করে সরল পাতা গজায়। পাতায় সরু নলের মতো বোঁটা থাকতে পারে। পাতা হলুদের পাতার মতো কিন্তু আরও ছোট। পাটিগাছে মাঘ-ফাল্গুন মাসে সাদা রঙের ছোট ফুল ফোটে। ফুল থেকে ফল হয়। ফলের বীজ চারা তৈরিতে কাজে লাগে।
পটিগাছের নানা নাম
আমাদের দেশে শুধু এক রকমের পাটিগাছ পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে ‘পাটিপাতা’ ও ‘পাটির জং’, নোয়াখালিতে ‘মস্তাক’, সিলেট ও টাঙ্গাইলে ‘পাইত্রাবন’ ‘পাটিবেত’ এবং বরিশালে ‘মূর্তা’ বলা হয়।
কোথায় পাওয়া যায়
আমাদের দেশে আগে সিলেট ও চট্টগ্রামের বনে পাওয়া যেতো। এখন শুধু চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নাটোর, দিনাজপুর জেলাসমূহের কিছু কিছু গ্রামে পাওয়া যায়। দেশের সব অঞ্চলের অব্যবহৃত বা কাজে লাগে না এমন ভেজা মাটিতে পাটিগাছ জন্মে থাকে।
চাষের যত সুবিধা
পাটিগাছ চাষে মাটি চষতে হয় না, তাই মাটির ক্ষয় রোধ করে। পাটিগাছ পরিবেশ উন্নত করে। পাটিগাছের কাণ্ড একটি অর্থকরী সম্পদ, কারণ কাণ্ড থেকেই মূল্যবান শীতলপাটি তৈরি হয়। পতিত জমির মাটি উন্নত করে ও মাটি ভেজা রাখে। জলাভূমিতে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করে। গাছের পাতা গরু-ছাগলের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
চাষবাস
পাটিগাছ চাষ বলতে এক জায়গাতে ও অন্য নতুন জায়গাতে বেশী করে গাছ লাগিয়ে গাছের কাণ্ডের পরিমাণ বাড়ানোকে বোঝায়। পাটিগাছের মোথা তুলে অন্য জায়গায় লাগিয়ে চাষ করা যায়। পাটিগাছের যেকোন গিঁটযুক্ত ডাল কেটে নিয়ে অন্য জায়গায় পুঁতে দিলেই নতুন গাছ তৈরি হয়। সাধারনত বর্ষাকালে গিঁটযুক্ত ডাল লাগানো হয়। পাটিগাছের বীজ থেকে চারা তৈরি করে সারিবদ্ধভাবে জমিতে লাগিয়ে চাষ করা যায়। পাটিগাছের মোথা তুলে বা গিঁট সহ ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে চাষ করা সবচেয়ে সহজ। সবাই এমন চাষ করতে পারে। বীজ থেকে চারা তৈরি করাও সহজ। তবে বীজ পাওয়া ও যতেœর সাথে চারা তৈরি করে পরে জমিতে লাগানো সবার জন্য সহজ হয়ে উঠে না। পাটিগাছ জমিতে লাগানোর ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যেই ফসল বা কাণ্ড টাকা যায়। তারপর প্রতি বছরই ফসল বা কাণ্ড কাটা যায়।
কোথায় লাগাবেন
ক্স বাড়ির সীমানায় বেড়া হিসাবে।
ক্স পড়ে থাকা পতিত নিচু জমিতে।
ক্স বসতবাড়ীর অব্যবহৃত জায়গায়।
ক্স পুকুর, খাল, নদী, ডোবার পাড়ে।
ক্স নলকূঁপ, পাতকুয়া, ড্রেন ইত্যাদির পাশে।
ক্স নিচু জমিতে কচুরিপানা সরিয়ে সেখানে।
ক্স আগাছা জন্মে এমন যে কোন উঁচু নিচু জমি ইত্যাদি।
গাছের যতœ-আতিœ
সাধারনত চারা তৈরি, রোপণ ও ঝাড় হওয়া পর্যন্ত যতœ-আতিœর প্রয়োজন হয়। পাটিগাছের জমিতে সামান্য পলিমাটি ও সার দেয়া ভাল।ঝাড় বা বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে। সাধরনত পাটিগাছে তেমনকোন রোগবালাই আক্রমন করেনা। কান্ড সংগ্রহের সময় ঝাড় থেকে পুরানো কাণ্ড আগে কাটতে হবে। ঝাড় থেকে একত্রে বেশী কাণ্ড আহরণ করা ঠিক নয়। তবে জমিতে শুয়ে পড়া কান্ডগুলো দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে। ঝাড় থেকে কাণ্ড তোলার সময় অন্য কাণ্ডের যাতে ক্ষতি নাহয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ঝাড় থেকে অপরিপক্ক কাণ্ড আহরণ করা যাবেনা। কাণ্ড আহরণের বয়স ও নিয়ম মেনে চলতে হবে।
পাটিগাছের শিল্পদ্রব্য
পাটিগাছের কাণ্ড থেকে কোন কিছু তৈরি করলে বা কোন কাজে লাগালে তাকে শিল্পদ্রব্য বলা হয়। এ গাছের প্রধান ও জনপ্রিয় শিল্পদ্রব্য হলো শীতলপাটি। পাটিগাচের কাণ্ড থেকে কাগজও তৈরি করা যায়। আমাদের দেশে পাটিগাছের ৪ ধরনের শিল্পদ্রব্য রয়েছে। এগুলো হলো বুননশিল্প, বয়নশিল্প, ক্ষুদ্র বুননশিল্প ও ক্ষুদ্র মিশ্রশিল্প। পাটিগাছের কাণ্ডের বেতি থেকে হাতে বুননের মাধ্যমে ঘরে বসে বড়ো বড়ো পাটি তৈরি করা হয়, যেমন- শীতল পাটি। পাটিগাছের বেতি থেকে বয়নযন্ত্র ব্যবহার করে বড়ো এক একটি পাটি বয়ন করা যায় ও নকশি কাজ করা যায়। যেমন- নকশি শীতল পাটি। পাটিগাছ থেকে বুননের মাধ্যমে শীতল পাটি ছাড়া অন্য ছোট দ্রব্য তৈরি করলে তাকে ক্ষুদ্র বুননশিল্প বলা হয়। উদাহরণ হলো- জায়নামাজ, খেলনা, ভ্যানিটি ব্যাগ, মানিব্যাগ, কুশন, আসন, ওয়ালম্যাট, পাদুকা, ফুলদানি, কলমদানি, ফুলদানী, ছোট বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি। পাটিগাছের বেতির সাথে বাঁশ ও বেতের তৈরি দ্রব্যের বুনন কাজ যোগ করে ক্ষুদ্র মিশ্রশিল্পদ্রব্য তৈরি হয়ে থাকে। উদাহরণ হলো- বেতের চেয়ারে শীতল পাটির কাজ, বাঁশের বাক্সে শীতল পাটির বুনন, বাঁশ বা বেতের দ্রব্যে শীতল পাটির বুনন কাজ ইত্যাদি। এছাড়া পাটিগাছ থেকে কাগজ ও পিজবোর্ড তৈরি করা যায়।
পাটিগাছের ক্ষুদ্র বুনন ও ক্ষুদ্র মিশ্রশিল্পের অধীন দ্রব্য ও আধুনিক শিল্পদ্রব্য তৈরি করলে খুব অল্প পাটিগাছ ব্যবহার করে অনেক টাকার দ্রব্য পাওয়া যায়। এতে অনেক লোকের রোজগারের সুযোগ হয়। পাটিশিল্পদ্রব্য আরামদায়ক ও পছন্দনীয় হওয়ায় বিদেশে রফতানি করা যায়। খুব ধারালো অস্ত্র ও যন্ত্র ব্যবহার করে বেশি মসৃণ করে ও নানান নকশি বুননের মাধ্যমে ও ক্ষুদ্র বুননের মাধ্যমে দ্রব্যের গুনগত মান বাড়ানো যায়। ভালো পাকা পাটিগাছের কাণ্ড ব্যবহার, বড়ো কাণ্ড শক্ত ঘন বুনন, মিহিবুনন ও শক্ত বাঁধনের মাধ্যমে শিল্পদ্রব্যকে টেশসই করা যায় । পাটিশিল্পদ্রব্য ৫% বোরিক পাউডারের পানি দ্রবণে ২ থেকে ৩ ডুবিয়ে রাখলে সহজেই পঁচে ও ঘুন পোকায় নষ্ট হয়না।
শিতলপাটির হালচাল
গরমে স্বস্তিদায়ক বলে গ্রামবাংলায় শীতলপাটির কদর যুগ যুগ ধরে। বিদ্যুতের দুর্ভোগের কারণে শুয়ে-বসে একটু শান্তি পেতে শহরেও অনেকে শীতলপাটি ব্যবহার করে। গায়ে হলুদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আভিজাত্য ও মর্যাদা বাড়ায় এই লোকজ ঐতিহ্য। সময়ের পরিক্রমায় বহুল ব্যবহারের তকমা হারিয়ে ফেলেছে শীতলপাটি। আশাজাগানিয়া খবর হলো, বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর নারী-পুরুষ ও শিশুদের পরম যতেœ বোনা এই শীতলপাটি দেশ ছাড়িয়ে সমাদৃত হচ্ছে বিদেশেও। প্রতিবেশী ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শীতলপাটির বাজারের সম্ভাবনা জেগে উঠছে। বিশেষ করে ভারতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি না পাওয়ায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে শীতলপাটি রপ্তানি শুরু হয়নি। ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমে এগুলো বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। দরকার সরকারের উদ্যোগ।
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও পিতৃপুরুষের পেশা আর নাড়ির টানের কিছু মানুষ আজো ধরে রেখেছে শীতলপাটি বোনার পেশা। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের পাটিকরপাড়া বা কাঁঠালিয়া গ্রামে গেলে দেখা মেলে এই পেশাজীবীদের। আজো ওই গ্রামের শতাধিক পরিবারের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম শীতলপাটি বুনন। এক পণ (৮০টি) পাইতরা বা পাটিগাছের দাম পড়ে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা। এক পণ বেতগাছে পাঁচ হাত লম্বা ও সাড়ে চার হাত প্রশস্ত নকশা করা একটি পাটি তৈরি করা সম্ভব।
পাইতরা গাছের বাকলের ওপরের অংশ দিয়ে দামি পাটি তৈরি হয়। গাছ চিকন করে কেটে বেতি তৈরি করা হয়। বাড়িতে এনে কাঁচা গাছ দা দিয়ে পাতলা করে ফালি করতে হয়। একেকটি গাছ তিন ফালি করে কাটা হয়। ফালির প্রথম অংশ ‘নেল’ বলে পরিচিত। এটি দিয়ে পাটি বোনা হয়। শেষ অংশ ‘বুকা’ ব্যবহার হয় ছটা ও জ্বালানি হিসেবে। নেল পাতলা করে কেটে গরম পানিতে সেদ্ধ করে তাতে রং লাগিয়ে, কখনোবা রং ছাড়াই শীতলপাটি বোনা হয়।
গ্রামগঞ্জের আর দশটা শিল্পের মতো পাটিশিল্প ও একটি ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলার বিসিক শিল্পনগরীগুলোতে এ শিল্পের বিকাশ লক্ষণীয়। এ শিল্পের বিকাশের জন্য পতিত জমিতে পাটিগাছের চাষ বৃদ্ধি করতে হবে একইসাথে স্বল্পসুদে চাষী ও শিল্পউদ্যেক্তাদের ঋনের ব্যবস্থা করতে হবে।
* লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ,
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com