ড. এএইচএম কোহিনুর ও মোঃ মশিউর রহমান
পাবদা মাছের প্রজনন ঃ বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে সুস্বাদু পাবদা মাছ আমাদের খুব প্রিয় মাছ হিসেবে সমাদৃত। অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন: নদী-নালা, খাল-বিল, প্ল¬াবনভূমি, ধানক্ষেত, হাওর, বাওড়ে এসব মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। বর্তমানে বাজারে এ মাছের সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশী হওয়ার কারণে বাজার মূল্য রুইজাতীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশী। সম্প্রতি বিপন্ন প্রজাতির এ মাছ নিয়ে গবেষণায় কৃত্রিম প্রজনন, পোনা লালন-পালন এবং চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিপন্ন প্রজাতির এই পাবদা মাছ চাষে চাষী ও উদ্যোক্তাদের মাছে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কৃত্রিম প্রজনন
পরিপক্কতাঃ পাবদা মাছ মাছ মোটামুটিভাবে এক বছর বা তার চেয়ে কিছুটা বেশী বয়সে পরিপক্কতা লাভ করে থাকে। তবে দুই বছর বয়সের পরিপক্ক মাছ কৃত্রিমভাবে প্রজননের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। চাষাধীন মাছ সুষ্ঠু খাদ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রুড হিসাবে গড়ে তুললে ভালো ফলাফল পাওযা যায়।
ডিমের সংখ্যাঃ দেশীয় মিঠাপানির অন্যান্য মাছের তুলনায় পাবদা মাছের ডিমের সংখ্যা তুলনামূলক কম। একটি পরিপক্ক ১২.৪-১৭.২ সেমি. আকারের পাবদা মাছ হতে ১,৫০০-৭,০০০ ডিম পাওয়া যায়। এ মাছের ডিমের আকার তুলনামূলক বড় এবং রং হালকা গোলাপী হয়ে থাকে। পরিপক্ক ডিম ভারী ও হালকা আঠালো হয়ে থাকে।
প্রজনন কালঃ এ মাছটির প্রজনন এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে জুন মাস এ মাছটির প্রজননের জন্য অত্যানুকূল সময়।
ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা
ক্স প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন বিল, হাওড় অথবা ভাল কয়েকটি হ্যাচারী থেকে সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত পাবদা মাছ সংগ্রহ করতে হবে
ক্স পরিপক্ক ব্রুড মাছ তৈরী করতে হলে শতাংশে ৫০-৮০ গ্রাম ওজনের ১০০-১২০ টি মাছ মজুদ করা যায়
ক্স সম্পুরক খাদ্য হিসাবে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজনের ৭-৮% সরবরাহ করতে হবে
ক্স ব্রুড মাছের পুকুরে প্রতি সপ্তাহে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অথবা প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর শতাংশ প্রতি ২০০-৩০০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে
ক্স এ পদ্ধতিতে ৫-৬ মাস পালনের পর মাছ প্রজননক্ষম হয়ে থাকে।
প্রজননক্ষম মাছ সনাক্তকরণঃ পরিপক্ক পুরুষ পাবদা মাছের পেক্টোরাল স্পাইনের ভিতরের দিকে খাঁজকাটা থাকে, অপরপক্ষে স্ত্রী মাছের পেক্টোরাল স্পাইনের ভিতরের দিকে খাঁজকাটা থাকে না। তাছাড়া প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট ডিমে ভর্তি থাকে বিধায় ফোলা দেখা যায় আর পুরুষ মাছের পেট চেপ্টা থাকে। একই বয়সের পুরুষ মাছ সাধারণত স্ত্রী মাছের তুলনায় আকারে ছোট হয়।
পাবদা মাছের প্রজনন কৌশল
ক্স কৃত্রিম প্রজননের জন্য পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পুকুর থেকে ধরে হ্যাচারীর ট্যাঙ্কে ৬-৭ ঘন্টা রাখা হয়ে থাকে
ক্স স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে কৃত্রিম প্রজননের জন্য পিজি ব্যবহার করা হয়। নি¤েœ বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা বর্ণনা করা হলোঃ
মাছের লিঙ্গ ১ম ডোজ (মিগ্রা.) ২য় ডোজ (মিগ্রা.) মন্তব্য
স্ত্রী ৩.০ ৭-৮ ১ম ইনজেকশান প্রয়োগের ৬ ঘন্টা পর ২য় ইনজেকশান দিতে হয়
পুরুষ ৬.০ ১৪-১৮
ক্স স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে পৃষ্ঠপাখনার নীচের মাংসে ইনজেকশন দেয়া হয়
ক্স অতপর ১ঃ১ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ২য় ইনজেকশন দেয়ার ৮-৯ ঘন্টা পর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে মাছ ডিম দিয়ে থাকে
ক্স ডিম দেয়ার পর ব্রুড মাছগুলোকে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়। সাধারনতঃ ১৮-২০ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয়
ক্স ডিম থেকে রেণু পোনা বের হওয়ার পর হাপাতে ২-৩ দিন রাখতে হয়। পরবর্তীতে রেণুগুলোকে ২ দিন সিদ্ধ ডিমের কুসুম দিনে ৪ বার খাবার হিসাবে দিতে হবে
ক্স স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে পৃষ্ঠপাখনার নীচের মাংসে ইনজেকশন দেয়া হয়
ক্স অতপর ১ঃ১.৫ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ইনজেকশন দেয়ার ১২-১৪ ঘন্টা পর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে মাছ ডিম দিয়ে থাকে
ক্স ডিম দেয়ার পর ব্রুড মাছগুলোকে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়। সাধারনতঃ ১৮-২০ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয়
ক্স ডিম থেকে রেণু পোনা বের হওয়ার পর হাপাতে ২-৩ দিন রাখতে হয়। পরবর্তীতে রেণুগুলোকে ২ দিন সিদ্ধ ডিমের কুসুম দিনে ৪ বার খাবার হিসাবে দিতে হবে
বর্তমানে পিজির পাশাপাশি বিভিন্ন সিনথেটিক হরমোন (ফ্লাশ, গোনাডিন, ওয়ানটাইম, ওভাপ্রিম ইত্যাদি) পাবদা মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাবদা মাছের প্রজনন উত্তর মাছের ব্যবস্থাপনাঃ কৃত্রিম প্রজননের পর ব্রুড মাছগুলোকে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেটের দ্রবণে ধৌত করে মাছগুলোকে প্রস্তুতকৃত পুকুরে সতর্কতার সাথে অবমুক্ত করতে হবে। প্রজননত্তোর পুকুরে নিয়মিত সম্পূরক খাবার প্রয়োগের পাশাপাশি পানির গুণাগুণ উপযোগী মাত্রায় রাখার জন্য প্রতি ১৫ দিন অন্তর ১০০ গ্রাম চুন ও ৩০০ গ্রাম হারে লবন প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাবদা পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা
নার্সারি পুকুরে পোনা বেঁচে থাকার হার নার্সারি ব্যবস্থাপনার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সে কারনে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত থেকে শুরু করে পোনা আহরণ পর্যন্ত অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। পাবদা পোনার নার্সারি নিম্মোক্ত পদ্ধতি অনুসরণে করা হয় ঃ
ক্স নার্সারী পুকুরের আয়তন ১৫-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হলে ভাল হয় ।
ক্স প্রস্তুতির সময় পুকুর ভাল ভাবে ৫-৭ দিন শুকিয়ে নিতে হয়
ক্স পুকুরের তলদেশ মই দিয়ে সমতল করতে হবে
ক্স অতপর: প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে
ক্স চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য শতাংশ প্রতি ৭০ গ্রাম খৈল ও ৭০ মিগ্রা. চিটাগুড় একত্রে মিশিয়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত ভিজিয়ে রেখে সূর্যলোক থাকা অবস্থায় সাড়া পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে
ক্স সার দেয়ার ০৩ দিন পর ১ কেজি ময়দা পানিতে গুলে প্রতি শতাংশে প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স হাঁস পোকা নিধনের জন্য প্রতি শতাংশে ১০ মিলি. সুমিথিয়ন রেণু ছাড়ার ২৪ ঘন্টা পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে
ক্স প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৩০-৫০ গ্রাম পাবদার রেণু পোনা ছাড়া যায়
রেণু মজুদের পর নিম্মবর্ণিত সারণি অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করতে হবেঃ
সারণী ১. নার্সারী পুকুরে খাদ্য সরবরাহের তালিকা
সময় কাল রেণুর ওজন খাদ্য প্রয়োগের নিয়ম
১-৩ দিন ১০০ গ্রাম ১০০ গ্রাম ময়দা ও ১টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তিন বার
৪-৭ দিন ১০০ গ্রাম ৪০% প্রেটিন সমৃদ্ধ ১০০ গ্রাম নার্সারী ফিড প্রয়োগ করতে হবে সকাল ও সন্ধ্যায়
৮-১৫ দিন ১০০ গ্রাম ৪০% প্রেটিন সমৃদ্ধ ২০০ গ্রাম নার্সারী ফিড প্রয়োগ করতে হবে সকাল ও সন্ধ্যায়
১৬-২৩ দিন ১০০ গ্রাম ৪০% প্রেটিন সমৃদ্ধ ৪০০ গ্রাম নার্সারী ফিড প্রয়োগ করতে হবে সকাল ও সন্ধ্যায়
২৪-৩০ দিন ১০০ গ্রাম ৪০% প্রেটিন সমৃদ্ধ ৫০০ গ্রাম নার্সারী ফিড প্রয়োগ করতে হবে সকাল ও সন্ধ্যায়
এভাবে নার্সারী পুকুরে রেণু প্রতিপালন করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ১.০-১.৫ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।
পাবদা মাছের চাষ পদ্ধতি
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
ক্স পাবদা মাছের একক/মিশ্র চাষের জন্য ৩০-৮০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৬-৭ মাস ৪-৬ ফুট পানি থাকে
ক্স পুকুর থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দূর করার জন্য মিহি ফাঁসের জাল বার বার টেনে এদের সরাতে হবে
ক্স রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দুর করার পর শতাংশে ১ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে হয়
ক্স চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর পোনা মজুদ করতে হয়
পোনার আকারঃ পাবদা মাছের একক/মিশ্র চাষের জন্য ৫-৭ সেমি. আকারের পাবদার পোনা, ১০-১২ সেমি. আকারের রুই জাতীয় মাছ, ৪-৫ সেমি. আকারের গুলশা মাছের পোনা এবং ৫-৬ সেমি. আকারের শিং মাছের সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা মজুদ ও চাষ ব্যবস্থাপনা
বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাবদা চাষ করা যায়। নিম্মে এ সমস্ত পদ্ধতির বর্ণনা করা হলোঃ
মাছের প্রজাতি | পদ্ধতি-১ | পদ্ধতি-২ | পদ্ধতি-৩ | |||
প্রতি শতকে | মজুদ সংখ্যা | উৎপাদন(কেজি) | মজুদ সংখ্যা | উৎপাদন (কেজি) | মজুদ সংখ্যা | উৎপাদন (কেজি) |
পাবদা | 1000 | 30-35 | 500 | 16-18 | 100 | 3-4 |
গুলশা | – | – | 300 | 6-8 | 150 | 3-4 |
রুই | – | – | 10 | 4-5 | 10 | 5-6 |
কাতলা | – | – | 5 | 2-3 | 8 | 5-6 |
মৃগেল | – | – | – | – | 7 | 4-5 |
শিং | – | – | – | – | 125 | 3-4 |
মোট | 1000 | 30-35 | 815 | 28-33 | 375 | 23-29 |
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
ক্স পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ভাসমান পিলেট খাদ্য রাতের বেলায় ২ বার প্রয়োগ করতে হবে
ক্স একক চাষে সার প্রয়োগের প্রয়োজন নাই। তবে, মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে
ক্স খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত এক দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। অত্যন্ত শীত এবং বৃষ্টির দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
পরিচর্যা
অপেক্ষাকৃত ভাল উৎপাদন পাওয়ার লক্ষে নিম্মবর্ণিত বিষয়সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবেঃ
ক্স পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রতি মাসে সঠিক মাত্রায় চুন ও লবন ব্যবহার করতে হবে
ক্স নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে
ক্স প্রতি সপ্তাহে একবার হররা টানতে হবে
ক্স পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে
ক্স পানির স্বচ্ছতা ২০ সেমি. এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে
উৎপাদন
ক্স পোনা মজুদের ৬-৭ মাস পর সমস্ত মাছ আহরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক্স মাছ আহরণের জন্যে প্রথমে বেড় জাল এবং পরে পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাছ চাষে এক ফসলে (৬-৭ মাস) আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (৫০ শতাংশ)
বিবরণ পদ্ধতি-১ (টাকা) পদ্ধতি-২ (টাকা) পদ্ধতি-৩ (টাকা)
পুকুর প্রস্তুতি ৫,০০০ ৫,০০০ ৫,০০০
পোনা ৭৫,০০০ ৫৫,০০০ ৩০,০০০
সার ০ ১,৫০০ ১,৫০০
মাছের খাদ্য ২২৫,০০০ ২৮০,০০০ ১১৫,০০০
অন্যান্য ৫০,০০০ ৫০,০০০ ৩০,০০০
মোট ব্যয় ৩৫৫,০০০ ৩৯১,৫০০ ১৮১,৫০০
মোট উৎপাদন (কেজি) ১,৬০০ ১,৫০০ ১,২৫০
মোট বিক্রয় ৮০০,০০০ ৬০০,০০০ ২৭৫,০০০
মোট আয় ৪৪৫,০০০ ২০৮,৫০০ ৯৩,৫০০