নিতাই চন্দ্র রায়
ফলদ বৃক্ষ মেলা ঃ ‘পরিকল্পিত ফল চাষ যোগাবে পুষ্টি সম্মত খাবার’- এ প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে সারা দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফলদ বৃক্ষ মেলা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ফল চাষে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। এ বিপ্লবের পেছনে ফলদ বৃক্ষ মেলা ও নার্সারির গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ নীরব বিপ্লবে যে ক’টি ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে আম, পেয়ারা পেঁপে ও তরমুজের অবদানই বেশি। বিগত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আজ থেকে ১০ বছর আগেও আম চাষ সীমাবদ্ধ ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, পাবনা ,কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরাসহ উত্তর-পশ্চিমের কয়েকটি জেলায়। তখন দেশে বছরে আম উৎপাদিত হতো মাত্র ১২ লাখ মেট্রিক টন। আম বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রচেষ্টা , আম চাষিদের আগ্রহ এবং মাঠ ফসলের চেয়ে বেশি লাভ হওয়ার কারণে আম উৎপাদন এখন দেশের ৩০টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকাতেও প্রসার লাভ করেছে ফলটির চাষ।
এ কাজে যে জাতগুলো বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সেগুলো হলো- বারিআম-৩( আ¤্রপালি), মল্লিকা, বারিআম -৪ ও বারি আম -১১। এসব নুতন জাতের আম সম্পর্কে ফল চাষিদের কোনো ধারণাই ছিল না। ছিল না উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান। নার্সারী মালিকেরা যখন টবে লাগানো থোকাথোকা আম ধরা ছোট ছোট গাছগুলি ফলদ বৃক্ষ মেলা প্রদর্শন করে , তখনই দেশের মানুষের মধ্যে নতুন জাতের আম চাষে সৃষ্টি হয় প্রবল আগ্রহ। মানুষ মেলা থেকে এসব জাতের আমের চারা কিনে রোপণ করে বাড়ির পাশপাশে, পুকুরের ধারে, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ ও বাসাবাড়ির ছাদে । রোপণের ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে এসব গাছে ফল ধরায় সারাদেশের মানুষ আম চাষে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠে। জানা যায়, দেশে উৎপাদিত আমের শতকরা ৪০ ভাগই হলো আ¤্রপালি জাতের। আ¤্রপালি আমের সুবিধা হলো- এটি সারা দেশে চাষযোগ্য। প্রতিবছরই ফল দেয়। অল্প জমিতে বেশি সংখ্যক গাছ লাগানো যায়। চারা রোপণের ২/৩ বছরের মধ্যে ফল দেয়। ফলের আকার মাঝারি। খেতে খুব মিষ্টি। শাসের রং লাল সোনালী। মৌসুমের শেষে আম পাওয়া যায়। ফলে কৃষক এ জাতের আম বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করতে পারেন। ময়মনসিংহসহ সারা দেশে বারিআম-৪ জাতের ভাল ফলন পাওয়া যাচ্ছে। বছরে তিন বার ফল দেয় বারিআম-১১। এজাতটিও ইদানিং ফলচাষিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে দেশে বেশ ক’টি বিদেশী জাতের আমের চাষ হচ্ছে। এসব বিদেশী জাতের আমের সাথে ফল চাষিদের পরিচয় ঘটে ফলদ বৃক্ষ মেলায় অংশগ্রহণকারী নার্সারির মাধ্যমেই। জাতগুলো হলো- ব্রুনাই কিং, ব্যানানা ম্যাগো, কিউজাই ও কাটিমন জাতের বারমাসী থাই আম।ব্রুনাইয়ের এক সুলতানের ফলবাগানে মালির কাজ করতেন মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার মোঃ ইব্রাহিম। তিনি সুলতানের বাগানে ৪/৫ কেজি ওজনের পাকা পেঁপের মতো আম দেখে সিদ্ধান্ত নেন- এজাতটি তিনি বাংলাদেশে নিয়ে যাবেন। পরবর্তীতে বাড়িতে আসার সময় তিনি ওই আমের একটি ডাল নিয়ে আসেন এবং স্থানীয় নার্সারী মালিক আতিয়ারের মাধ্যমে চারা তৈরি করে নিজের জমিতে রোপণ করেন এবং যতœ করে বড় করে তুলেন। তার ৫ বছর বয়েসী আম গাছে এবার ৫০ টি আম ধরেছে। প্রতিটি আমের ওজন ৪ থেকে ৫ কেজি। আমতো নয়; যেন একটি পাকা পেঁপে। তার ওই আম গাছ দেখার জন্য সারা দেশ থেকে বহু লোক আসে প্রতিদিন।তিনি প্রতিটি আম ৫০০ টাকা করে বিক্রি করেন। ইব্রাহিমের কাছ থেকে সায়ন সংগ্রহ করে মাগুড়া হর্টিকালচার সেন্টার চারা তৈরি এবং বিক্রি করছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের সুমি নার্সারীতেও এ জাতের আমের চারা পাওয়া যাচ্ছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। কাটিমন থাই জাতের বারমাসী আম চাষ করে অনেক আম চাষি বেশ লাভবান হচ্ছেন।কারণ অমৌসুমে প্রতিকেজি আম ২০০ থেকে ৩০০ টাকাতেও বিক্রি হয়। এজাতের ফলনও বেশ ভাল।অন্যদিকে ব্যানানা ম্যাগো ও কিউজাই জাতের আম চাষেও লাভবান হচেছন কৃষক। ছাদ বাগানেও এ জাতগুলোর চাষ করা যায়।
২০ বছর আগেও বাংলাদেশে আম, কাঁঠাল, লিচু ও কলাই ছিল প্রধান ফল। আর এখন ৭২ প্রজাতির ফল চাষ হচ্ছে ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার হিসেবে গত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে ১১ শতাংশ হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, গত এক যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু ফল পরিভোগের পরিমাণও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে এটি ছিল ৫৫ গ্রাম । এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ গ্রামে।আমাদের দরকার দৈনিক ২০০ গ্রাম।
অন্য ফসলের চেয়ে ফল চাষে সুবিধা বেশি।বসতবাড়ির আশপাশ, রাস্তার ধার, পুকুর পাড়, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের অব্যবহৃত উঁচু জমি, বাড়ির ছাদ, হাফ ড্রামেও করা যায় ফলের চাষ। দানা শস্যের তুলনায় বেশি লাভ, বাজারে প্রচুর চাহিদা ও বেশি দামের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাড়ছে ফল উৎপাদন। এক বিঘা জমিতে ধান চাষে বছরে যেখানে লাভ হয় ৫ হাজার টাকা, সেখানে আম চাষে লাভ হয় ৫০ হাজার টাকা। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলদেশ দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। ফল উৎপাদনের এই বিস্ময়কর সফলতার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাকৃবির জার্ম প্লাজম সেন্টার থেকে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন , সরকারি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের নার্সারিগুলো থেকে সুলভ মূল্যে কৃষকদের মধ্যে উন্নত জাতের চারা সররাহ ও কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সারা দেশে ফলদবৃক্ষমেলার মাধ্যমে মানুষকে ফল চাষে উদ্বুদ্ধকরণ। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-গঞ্জের বেসরকারি ক্ষুদ্র ও মিনি নার্সারিগুলোর অবদানও কম নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত নার্সারির সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার এবং এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ওপর। প্রায় ৫ লাখ মানুষ এ খাতের সাথে যুক্ত।
গত ১০ বছরে দেশে পেয়ারার উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ- এই সফলতার পেছনে থাইজাতের পেয়ারার অবদানই সবচেয়ে বেশি।জাতগুলো হলো থাই পেয়ার-৩, থাই পেয়ারাÑ৫ ও থাইপেয়ারা-৭। ২০০৭-০৮ সালে দেশে পেয়ারার উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৬ হাজার টনে। বর্তমানে দেশে তরমুজ উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২১ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে দেশে ১ কোটি ২১ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। ১০ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া বিদেশি ফলের মধ্যে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, অ্যাডোকাডো ,রাম্বুটান, মাল্টা ও ভিয়েতনামী খাটো জাতের নারকেলের চাষ দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে দেশের ফল চাষিদের কাছে ফলদ বৃক্ষ মেলার কারণেই।
দেশে পেঁপের মধ্যে শাহী, কাশেমপুরী ও রেডলেডি জাতের পেঁপের চাষ হচ্ছে বেশি। তবে বেসরকারি নার্সারীগুলো থেকে এসব জাতের পেঁপের চাষ করে কৃষক চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমার জানা মতে ফুলবাড়িয়া উপজেলার জঙ্গলবাড়ি গ্রামের নাজমুল হক নামের একজন উদ্যোক্তা ৫০০টি রেড রেডি জাতের গাছ লাগান। রোপণকৃত গাছগুলো ফল ধরার আগেই মোজাইক রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনষ্ট হয়ে যায়। এতে তিনি প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। অন্যদিকে ত্রিশাল উপজেলার নওধার গ্রামের রিপন নামের একজন ফল চাষি স্থানীয় নার্সারী থেকে কাশেমপুরী জাতের ১১০টি পেঁপের চারা ৮শতক লাগিয়ে একই রকম ক্ষতির শিকার হন। আমাদের পরামর্শ- গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যাদতত্ত্ব বিভাগ থেকে শাহী জাতের বীজ সংগ্রহ করে নিজে চারা তৈরি করে লাগালে কৃষক এ সমস্যা থেকে অনেকটা রক্ষা পাবেন। দেশে যে সকল ভাল জাতের লিচু চাষ হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে বোম্বাই, বেদানাও চায়না-৩ উল্লেখযোগ্য।এসব জাতের সাথে কৃষকে পরিচয় করিয়ে দেয় ফলদ বৃক্ষ মেলাই। এ ছাড়া এ মেলায় এলকার কৃষক তাদের গাছের সবচেয়ে ভাল ফলগুলি প্রদর্শন করার সুযোগ পান। মেলায় প্রদর্শিত এসব ফল দেখে আগত ফল চাষিদের মধ্যে উন্নত পদ্ধতিতে ফল চাষের আগ্রত জন্মে।মেলায় এলাকার স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এসে দেশে চাষকৃত বিভিন্ন ধরনের ফলের সাথে পরিচিত হওয়ার সুয়োগ পায়।এতে তাদের মধ্যে ফলদ বৃক্ষ রোপণ, ফলের উপকারীতা এবং পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষের অসীম অবদান সর্ম্পকে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়।বৃক্ষের প্রতি জাগে নিবিড় ভলোবাসা ও অপরিসীম মমত্ববোধ।
বর্তমানে দেশে আম, পেয়ারা ও পেঁপের সাথে বারি মাল্টা-১, ভিয়েতনামী খাটো জাতের নারকেল ও বারি-১ জাতের লটকনের চাষও জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। রোপণের তিন বছরের মধ্যেই এসব জাতের গাছে ফল পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ফল উৎপাদনে ঘটেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। এ বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন ফল ফসলের জাত উদ্ভাবন, গ্রামে-গঞ্জে মানসম্মত নার্সারি স্থাপন, ফলদ বৃক্ষ মেলার মাধ্যমে মানুষকে ফল চাষে উদ্বুদ্ধ করণ ও ফল চাষে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করাসহ নিরাপদ ফল উৎপাদন, ফল প্রক্রিয়াকরণ ও ফল রপ্তানির দিকে বেশি নজর দিতে হবে । সেই সাথে প্রতিটি উপজেলায় সরকারিভাবে উদ্যানতত্ত্ব নার্সারী স্থাপন করে স্বল্প মূল্যে উন্নত জাতের মান সম্মত ফলের চারা ফল উৎপাদনকারীদের নিকট সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া নার্সারী মালিকদের দিতে হবে সহজ শর্তে প্রয়োজনীয় ঋণ। ফলের চারা বিক্রির জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন এবং উপজেলা সদরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আলাদা বাজার, যাতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক নার্সারী মালিকেরা অনায়াসে বিক্রি করতে পারেন তাদের উৎপাদিত ফলের চারা। অপরদিকে নার্সারী মালিকদের মধ্যে বিনামূল্যে নতুন উদ্ভাবিত ফলের মাতৃগাছ সরবরাহ ও তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এভাবেই আমাদেরকে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।
লেখকঃ সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ,গোপালপুর , নাটোর
ইমেইলঃ netairoy18@yahoo.com