কৃষিবিদ মোঃ আরিফ হোসেন খান
জিরা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা ঃ ২০১৮-১৯ রবি মৌসুমে যুগ্ম-পরিচালক (সার), রাজশাহী দপ্তরের ছাদের টবে কিছু জিরা চাষ করা হয়। ছোট বড় মোট ১২টি টবে জিরা বপণ করা হয় নভেম্বর মাসের শেষ দিকে। মৌসুম শেষে ৩০ গ্রাম শুকনা জিরার বীজ পাওয়া যায় ১৮.৩.১৯ তারিখে। এই জিরার গন্ধ খুব সুন্দর পরিলক্ষিত হয়, জিরার আকার ভালো এবং রংও বেশ আকর্ষণীয়। সুতরাং আমরা যদি দেশে নিবিড়ভাবে জিরা চাষের বিষয়ে উদ্যোগী হই তবে সফলতা পাবার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। সূচনাঃ– গত ২০১৮-১৯ রবি মৌসুমে মাননীয় কৃষি সচিব জনাব মোঃ নাসিরুজ্জামান মহোদয় (বিএডিসি’র তৎকালীন মাননীয় চেয়ারম্যান থাকাকালীন) রাজশাহী এলাকাতে জিরা চাষ বিষয়ে খোঁজ খবর করার জন্য আমাকে নির্দেশনা প্রদান করেন। সেমতে খোঁজ করতে গিয়ে কয়েকজন জিরা চাষির সন্ধান পাই। এরমধ্যে একজন চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাটের জনাব মোঃ সাদেক হোসেন সাহেব প্রথম ভারতের গুজরাট থেকে কিছু বীজ নিয়ে এসে ৫ বিঘা জমিতে বপণ করেন। কিন্তু চাষ পদ্ধতি না জানার কারণে তার সমুদয় ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এবছর সাদেক সাহেবের আতœীয় তানোর উপজেলার বিল্লিহাট এলাকার চাষি জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ কিছু বীজ বপণ করে জিরা চাষ করেন এবং কিছুটা সফলতা লাভ করেন। সে বছরে অর্থাৎ ২০১৬-১৭ বছরে বাগমারা থানার গাঙ্গোপাড়া হাট এলাকার একজন চাষি জিরা চাষ করেন এবং অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে তার জিরা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান। এছাড়া জামালপুরের মোহাম্মদ আলী নামক একজন জিরা চাষির খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি এক বিঘা জমিতে জিরা চাষ করেছিলেন বলে জানান। তিনি দেশে জিরা চাষি সমিতি করেছেন বলেও জানান। যা হোক, পরবর্তীতে তার নম্বরে কল দিয়ে তাকে আর পাওয়া যায়নি। গত মৌসুমে তানোরের চাষি মোঃ আব্দুল হামিদের নিকট থেকে মাত্র ১০ গ্রাম বীজ পাই। এই বীজ এ বছরে অফিস ক্যাম্পাসের মাটিতে বেড করে বপণ করলেও অঙ্কুরোদগম হার বেশ কম পরিলক্ষিত হয়। স্থানটি ছায়াযুক্ত হবার কারণে পরবর্তীতে বেড থেকে জিরা গাছ তুলে টবে লাগিয়ে ছাদে রাখা হয়। এখান থেকেই ৩০ গ্রাম বীজ পাওয়া যায়। বীজ শুকিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যা আগামী বছরে আবার ছাদে এবং বিএডিসির কিছু খামারে বপণ করে জিরা উৎপাদনের চেষ্টা করা হবে।
যেভাবে পরিচর্যা করা হয়েছিলঃ– ধনিয়া, কালজিরা, রাধুনী এবং মৌরী চরাঞ্চলে চাষাবাদ হয় বলে আমার ধারণা হয়, মাটিতে বালুর ভাগ বেশী থাকলে সেটা ভালো হবে। এজন্য টবের মাটি তৈরীর সময় মাটির সাথে পঁচা চা পাতা (খুব ভালোভাবে পঁচা এবং গুড়া করা গোবর সার দেওয়া যেতে পারে) এবং কিছু ভরাট বালু মিশিয়ে তৈরী করি। গাছ লেগে যাবার পরে টবের মাটিতে কিছু ডিএপি এবং এমওপি সার প্রয়োগ করি। এর কয়েকদিন পরে কিছু ইউরিয়া সার দেই।। টবের আকার অনুযায়ী প্রতি টবে ২টি থেকে ৮টি জিরা গাছ লাগাই। এসময়ে অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি ম্যাজিক গ্রোথ, ৫ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৩ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে ৭ দিন পরপর বিকাল বেলায় নিয়মিত স্প্রে করা হয়েছে। সর্বমোট ৮ বার স্প্রে করা হয়েছে। এই স্প্রে করার সময় ১৪ দিন পরপর ছত্রাকনাশক (ডায়থেন এম-৪৫) এবং কীটনাশক (এডমায়ার) স্প্রে করা হয়েছে। টবে প্রতিদিন বিকাল বেলা একবার করে পরিমিত পরিমাণ পানি দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করা গেছে যে ফেব্রুয়ারি মাসে জিরা গাছে জাব পোকার আক্রমণ হয়ে থাকে। যে টবে বেশী গাছ দিয়েছিলাম সেগুলো বেশী ভালো হয়েছে। সুতরাং এ তথ্যটি আগামীতে ভালো সহায়ক হবে। বাংলাদেশে জিরা চাষের সম্ভবনাঃ– জানা যায় ফসলটি ভারতের খরা প্রবণ এলাকা গুজরাটে চাষ হয় এবং কুয়শার প্রতি বেশী সংবেদনশীল। একারণে এই ফসলটি বরেন্দ্র এলাকা (মাটিতে অধিক জৈব সার দিয়ে তৈরী করে নিতে হবে), নাটোরের লালপুর এবং পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ও বগুড়াসহ দেশের চরাঞ্চলের বেলে দোআঁশ মাটিতে চাষের সম্ভবনা রয়েছে। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে, বিশেষ করে ছত্রাকনাশক এবং কীটনাশক স্প্রের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ঘন কুয়াশার সময়ে প্রয়োজনে ২/৩ দিন পরপর স্প্রে করে গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ঘন কুয়াশার সময়ে পলিথিন দিয়ে গাছ ঢেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। জিরা চাষ করতে হবে বেড পদ্ধতিতে যেন কোনভাবে বৃষ্টির পানি/ সেচের পানি গাছের গোড়াতে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে না পারে। এক্ষেত্রে পুষ্টি প্রদানের ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলটি অধিক সহায়ক হতে পারে।
ছাদে কেন ভালোভাবে জিরা হলোঃ– বাংলাদেশে যারা জিরা নিয়ে কাজ করছেন সেই সকল চাষি এবং গবেষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, জিরা ফসলটি খরাপ্রবণ এলাকা এবং কম কুয়াশা হয় এমন স্থানে ভালো হবে। যেহেতু ছাদের তাপমাত্রা কিছুটা বেশী থাকে এবং পানি ব্যবস্থাপনাটি সঠিকভাবে করা গেছে এবং এ বছরে কোন কুয়াশা হয়নি এজন্য ছাদে জিরা চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে। নতুন একটি তথ্যঃ– আমাদের সাধারনভাবে ধরণা যে বাজারে যে সকল জিরা পাওয়া যায় তা থেকে বীজ গজায় না, সেগুলো নাকি গরম পানি দিয়ে নষ্ট করে তারপরে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু এবারে ফেসবুকে পোস্ট দেবার সময়ে অনেকেই বলেন যে তারা বাজারের জিরা লাগিয়ে গাছ করতে পেরেছেন এবং তাদের ছাদে জিরা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এর একজন এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুইটি সুলতানা জানান তার আম্মা আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগে কিচেন গাডেনে বাজারের জিরা লাগিয়ে জিরা করতেন। তিনি তার মাকে এ কাজে সহায়তা করতেন। তিনি এবছরে আমার পোস্ট দেখে টবে জিরা লাগিয়েছেন এবং জিরা গজিয়েছে বলেও জানান। সুতরাং আমরা যদি বিভিন্ন উৎস থেকে আসা জিরা বাজার থেকে কিনে স্বল্প পরিসরে চাষের চেষ্টা করি তাহলে, আমার মনে হয় ভালো তথ্য পাওয়া যাবে। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনাব মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ জানান যে, সিরিয়ার উৎসের বীজ বাজার থেকে কিনে লাগিয়ে দেখেছেন যে বীজ ভালো গজিয়েছে এবং জিরা হয়েছে। সিরিয়ার এই জিরার জাতটি বেশ সম্ভাবনাময় বলে তিনি জানান।