# বকুল হাসান খান #
শুভ নববর্ষ। বাংলার নববর্ষের সূচনা বৈশাখে। এ মাস দিয়েই শুরু ষড়ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখর তাপে তেতে যায় মাটি। মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়ের তাণ্ডবে ঝরে পড়ে গাছের কটি আম। উল্লাসে মেতে ওঠে কিশোর-কিশোরী। ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে আনন্দ পায় তারা। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিমনা মানুষ বৈশাখী মেলায় হয় একীভূত। আর চাষিভাইয়েরা কালবৈশাখীর আতঙ্কে ঘরদোর মেরামতের কাজ সেরে মাঠের ফসলের দিকে সজাগ দৃষ্টিতে থাকেন তাকিয়ে। প্রিয় পাঠক, আনন্দ আর আতঙ্কের সন্ধিক্ষণে চলুন জেনে নেই বৈশাখ মাসে কৃষিতে করণীয় নানান দিক। শুরুতেই ধান।
ধান
বোরো ধান ক্ষেতে এখন থোড় আসার সময়। আপনার ক্ষেতের ধান গাছে থোড় আসা শুরু হলে জমিতে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। আবার ধানের দানা শক্ত হয়ে গেলে জমির পানি বের করে দিন। বৈশাখ মাসে বোরো ধান ক্ষেতে মাজরা পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধি পোকা, লেদা পোকা, শিষ কাটা লেদা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া বাদামি দাগ রোগ, ব্লাস্ট রোগ, পাতা ঝলসানো রোগসহ অন্যান্য রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। পরিমিত সার ব্যবস্থাপনা, সেচ, সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা (আইপিএম), আন্তঃপরিচর্যা অবলম্বন করে ফসল রক্ষা করুন। রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত না হলে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করুন। বোনা আউশ ও বোনা আমন ক্ষেতের আগাছা পরিস্কার করুন এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যতœ নিন।
পাট
এখন তোষা পাট বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাট চাষ করতে চাইলে ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করুন। তোষা পাটের উন্নত জাত হলো ও-৪ এবং ফাল্গুনী তোষা। দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে তোষা পাটের উৎপাদন ভালো হয়। তোষা পাট চাষের জন্য বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করে নিন। প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স বা ১৫০ গ্রাম রসুন পিষে বীজের সাথে মিশিয়ে নিন এবং রোদে শুকিয়ে জমিতে বপন করুন। এতে বালাইয়ের আক্রমণ কম হবে। বীজ সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করতে পারেন। সারিতে বুনলে এক হেক্টর জমির জন্য ৪-৫ কেজি এবং ছিটিয়ে বুনলে ৬-৮ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তোষা পাট চাষের জন্য সুষম হারে সার প্রয়োগ করুন। প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, এমওপি ৬০ কেজি প্রয়োগ করুন। এছাড়া ৪-৫ টন গোবর বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করুন।
ভুট্টা
এ সময় ভুট্টা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময়। ভুট্টার মোচা সংগ্রহ করে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন অথবা বিক্রির ব্যবস্থা নিন। খরিফ মৌসুমে অনেকেই হয়তো ভুট্টা চাষ করেছেন। খরিফ ভুট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করুন। মাটিতে রস কম থাকলে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিন। একই সাথে আগাছা পরিস্কার করুন এবং গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিন।
ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ শুরু করেছেন। সবজি চাষ শুরু না করলে এখনই গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের উদ্যেগ নিন। চিচিঙা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, করলা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়াসহ অন্যান্য সবজির জন্য মাদা তৈরি করুন। মাদার মাটির সাথে ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি এবং পরিমাণমতো জৈব সার ভালো করে মিশিয়ে নিন এবং সপ্তাহখানেক পরে মাদায় বীজ বা চারা রোপণ করুন। গ্রীষ্মকালীন এসব সবজি লতানো বলে মাচা তৈরি করুন। কুমড়াজাতীয় সবজিতে কৃত্রিম পরাগায়নের প্রয়োজন পড়ে। এতে ফলন বেশি পাওয়া যায়। আবার এসব ফসলে মাছি পোকার উপদ্রব দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার করে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। একশত গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়া থেঁতলিয়ে তাতে আধা গ্রাম ডিপটেরেক্স-৮০ বা আধা মিলিলিটার ডিডিভিপি বা ১০ ফোঁটা ডারসবান মিশিয়ে একটি বাটিতে রেখে মাচায় ঝুলিয়ে দিন। ২/৩ দিন পর বিষটোপ বদলিয়ে দিন। এক হেক্টর জমিতে ৩৫-৪০টি বিষটোপ ফাঁদ প্রয়োজন হয়। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের উদ্যোগ নিন। এ ক্ষেত্রে বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো-৫, বারি টমেটো-৬, বারি টমেটো-১০, বারি টমেটো-১১, বিনা টমেটো-১, বিনা টমেটো-২ জাতের চাষ করতে পারেন।
গাছপালা
এ সময় নারকেলের চারা রোপণ করতে পারেন। আলো বাতাসপূর্ণ উঁচু স্থানে নারকেলের চারা রোপণ করুন। রোপণের সময় লম্বা জাতের জন্য ৮ মিটার এবং খাটো জাতের জন্য ৬ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করুন। চারা রোপণের আগে এক মিটার চওড়া ও এক মিটার গভীর গর্ত করে গর্তের মাটিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫০ গ্রাম টিএসপি, ৫০০ গ্রাম এমওপি, ৫০০ গ্রাম জিপসাম এবং ১২০ গ্রাম দস্তা সার প্রয়োগ করুন। আমের উইভিল পোকা, মাছি পোকা, পাতার কাটা উইভিল, গল মাছি লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করতে সঠিক বালাইনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করুন।
মাছ চাষ
বৈশাখ মাস পুকুরে মাছ ছাড়ার উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে পুকুর তৈরি করে নিন প্রথমে। এজন্র আপনাকে পুকুর শুকিয়ে আগাছা পরিস্কার করতে হবে এবং চুন প্রয়োগ করতে হবে। অতপর পানি দিয়ে পুকুর ভরে মাছ ছাড়ার উদ্যোগ নিন। মিশ্র মাছ চাষের জন্য ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা সুস্থ সবল পোনা ছাড়ুন এজন্য আপনার পোনা লাগবে ৩০-৪০টি। পানির তিন স্তরে থাকে এমন মাছ ছাড়ুন পুকুরে। যেমন- তেলাপিয়া, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, সিলভার কার্র্র্র্প, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালো বাউস এসব। এরপর নিয়মিত পুকুরে তদারকি করুন, মাছের খাবার সরবরাহ করুন এবং স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন। মাছ চাষের যে কোনো সমস্যা সমাধানে উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করুন।
পশুপালন
গবাদিপশুর খাবার সরবরাহ করতে নেপিয়ার, প্যারা, ভুট্টা, ইপিল চাষ করুন এখন। তাছাড়া ইউরিয়া মোলায়েম ব্লক বা ইউরিয়া মোলাসেস খড় তৈরি করে গবাদিপশুকে খেতে দিন। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিয়ে দিন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ গবাদিপশুকে দুর্বল করে ফেলে, তাই প্রখর রোদে গবাদিপশুকে না রেখে ছায়ায় রাখুন এবং নিয়মিত পানি খেতে দিন। যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে যোগযোগ করুন। প্রিয় পাঠক, নতুন বছরে আপনার কৃষি হয়ে উঠুক নতুন প্রযুক্তিতে ভরপুর। নিজের সমৃদ্ধি এবং দেশের স্বনির্ভরতায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির বিকল্প নেই। এজন্য কথা বলুন আপনার পাশের উপসহকারী কৃষি অফিসারের সাথে। পরামর্শমতো কাজ করলে লাভবান হবে দেশ। কথা হবে আগামী মাসে জ্যৈষ্ঠের কৃষি নিয়ে। সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম
তথ্যবহুল লেখা