নিতাই চন্দ্র রায়, ময়মনসিং হ থেকেঃ
বোরো ধানের ব্লাস্ট রোগ ঃসারাদেশে এখন চলছে বোরো ধান রোপণের ধূম । কৃষক কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি তৈরি, চারা তোলা ও চারা রোপণ কাজে ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করছেন। সম্প্রতি (০৪.০১.২০১৯) ময়মনসিংহের ত্রিশালে কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে ধানীখোলা দক্ষিণ ভাটিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বোরো ধান চাষিদের সাথে একটি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত চাষিরা জানান, গত বছর যারা ব্রি ধান ২৮, ব্রিধান ২৯ ও ব্রিধান ৫৮ চাষ করেছিলেন তাঁদের জমিতে এক ধরনের রোগের কারণে ধান চিটা হয়ে যায়। এতে ধানের ফলন হ্রাস পায় এবং ধানচাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলে রোগের নাম, কারণ ও রোগদমনের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেন নি।আমার ধারণা দেশের অধিকাংশ কৃষকই ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে তেমন সচেতন নন।
ধানের ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত মারত্মক ক্ষতিকারক রোগ। আমাাদের দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে রোগটির আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। অনুকূল আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণে ধানের ফলন ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় রোগটি দেখা দিতে পারে।এ রোগটি সাধারণত ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯, ব্রিধান ৫৮, লবণ সহিষ্ণু জাত, সুগন্ধী ও হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং শীষে আক্রমণ করে থাকে। সে অনুযায়ী রোগটি পাতা ব্লাস্ট, গিঁটব্লাস্ট ও নেকব্লাস্ট নামে পরিচিত। পাতা ব্লাস্ট ধানের চারা ও কুশি অবস্থায় আক্রমণ করে। প্রথমে পাতায় ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানটা ধূসর ও কিনারা বাদামি রং ধারণ করে। দাগুলো একটু লম্বাটে এবং দেখতে অনেকটা চোখের মতো। একাধিক দাগ মিশে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো পাতাটি শুকিয়ে মারা যেতে পারে। পাতার চেয়ে গিঁট ও শীষ আক্রান্ত হলে ধানের বেশি ক্ষতি হয়। ধান গাছে থোড় হওয়ার আগে থেকেই গিঁট ব্লাস্ট দেখা দেয়। গিঁট আক্রান্ত হলে কালো দাগ সৃষ্টি হয় ও পচে যায়। প্রবল বাতাসে আক্রান্ত স্থান ভেঙ্গে যেতে পারে তবে একদম আলাদা হয়ে যায় না। শিশির বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সময় ধানের ডিগ পাতা ও শীষের গোড়ার সংযোগ স্থলে পানি জমে। ফলে উক্ত স্থানে ব্লাস্ট রোগের জীবাণু আক্রমণ করে কালচে বাদামি দাগ তৈরি করে। পরবর্তীতে আক্রান্ত শীষের গোড়া পচে যাওায় গাছের খাবার শীষে যেতে পারে না, ফলে শীষ শুকিয়ে দানা চিটা হয়ে যায়। দেরিতে আক্রান্ত শীষ ভেঙ্গে যেতে পারে। শীষের গোড়া ছাড়াও যে কোনো স্থানে এ রোগের জীবাণু আক্রমণ করতে পারে।
ব্লাস্ট রোগের জীবাণু প্রধানত বাতাসের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আর যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই জীবাণু গাছের ওপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।বীজের মাধ্যমে রোগটি ধানের চারায় ছড়াতে পারে, তবে তা পরিমাণে খুবই কম।
প্রাথমিক অবস্থায় নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ সহজে সনাক্ত করা যায় না। সাধারণভাবে যখন জমিতে নেক ব্লাস্ট রোগের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়, তখন জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। সে সময় অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কার্যকরভাবে রোগটি দমন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য কৃষক ভাইদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
দিনের বেলায় গরম ( ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠা-া ( ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) , শিশিরে ভেজা দীর্ঘ সকাল, অধিক আর্দ্রতা (৮৫% বা তার অধিক). মেঘাচ্ছন্নন আকাশ, ঝড়ো আবহাওয়া এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এ রোগের আক্রমণের জন্য খুবই অনুকূল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে জমিতে বিঘা প্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার এবং সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদী জাতের বেলায় বিঘা প্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ১৩ কেজি টিএসপি/ডিএপি, ২২ কেজি পটাশ, ১৫ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি দস্তা সার এবং স্বল্প মেয়াদী জাতের বেরায় উল্লিখিত রাসায়নিক সারগুলো যথাক্রমে বিঘা প্রতি ৩৫, ১২, ২০, ১৫ ও ১.৫ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়, তবে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া কম লাগে। পাটাশ সার দুই সমানভাগে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম ভাগ জমি তৈরির সময় এবং ২য় ভাগ শেষ কিস্তি ইউয়িা সার উপরি প্রয়োগের সময়। সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত ধানের জমি থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া যেসব জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ এলাকায় রোগের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান, সেখানকার ধানের জমিতে রোগ হোক বা না হোক, শীষ বের হওয়ার আগ মুহুর্তে প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৮ গ্রাম ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি/ দিফা ৭৫ ডব্লিউপি, অথবা ৬ গ্রাম ন্যাটিভো ৭৫ ডব্লিউজি ছত্রাক নাশক ১০ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে শেষ বিকেলে ৫ থেকে ৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।এছাড়া ধানের জমিতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিলে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে ১ থেকে ২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। পাতা ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় একই নিয়মে নির্দিষ্ট মাত্রায় অনুমোদিত ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হচ্ছে। বোরো মৌসুমে শতকরা ৪১ ভাগ জমিতে ব্রিধান ২৮ এবং ২৪ ভাগ জমিতে ব্রিধান ২৯ এর চাষ হয়। অর্থাৎ বোরো ধানের প্রায় ৬৫ ভাগ জমি দখল করে আছে এই দু’টি ম্যাগা ভ্যারাইটি।আজ থেকে ২৪ বছর আগে ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত জাত দুইটিতে নানা রকম রোগ আক্রমণের স¤ম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার সক্ষমতাও জাত দু’টির হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের কোনো কোনো স্থানে জাত দু’টিতে ব্যাপক ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অল্প ক‘দিন আগে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পলাশতলী গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ওই গ্রামের প্রায় ২০ একর ব্রিধান ২৮ জাতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের কারণে ধানের ফলন হ্রাস পায় এবং কৃষক আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। কোন কোন কৃষক ক্ষেত থেকে এক মুঠো ধানও বাড়িতে আনতে পারেননি এবং উৎপাদিত খড়ও গরুকে খাওয়াতে পারেন নি। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মধ্যে রয়েছেন, মোঃ নজরুল ইসলাম, মোঃ জালাল উদ্দিন ও মোঃ নসর আলী প্রমুখ। তাই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ জাত দু’টির বিকল্প হিসেবে ব্রিধান ৮৮ ও ব্রিধান ৮৯ উদ্ভাবন করছে।ব্রিধান ৮৮ ব্রিধান ২৮-এর মতো স্বল্প মেয়াদী। এজাতের জীবন কাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। ব্রিধান ২৮-এর হেক্টর প্রতি স্বাভাবিক ফলন যেখানে ৫ থেকে ৬টন, সেখানে ব্রিধান ৮৮- এর ফলন সাড়ে ৬ টন। অন্যদিকে ব্রিধান ৮৯ এর জীবন কাল ১৫৪ থেকে ১৫৮ দিন।ব্রিধান ২৯-এর স্বাভাবিক ফলন যেখানে সাড়ে সাত টন, সেখানে ব্রিধান ৮৯-এর ফলন হেক্টর প্রতি ৮ টন। তাই ধান বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, নতুন জাত; ব্রিধান ৮৮ ও ব্রিধান ৮৯ কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা গেলে দেশে ধানের উৎপাদন আগের চেয়ে বেশি হবে।
ব্লাষ্ট রোগের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে এবছর ব্রিধান ২৮ ও ব্রিধান ২৯-এর পরিবর্তে ব্রিধান ৫৮ এবং বিভিন্ন বীজ কোম্পানির হাইব্রিড জাতের ধান আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষক।অপরদিকে প্রচলিত জাতের চেয়ে হাইব্রিড জাতের ফলন বেশি। চাল চিকন, খেতে সুস্বাদু। দেশে বোরো মৌসুমে চাষকৃত হাইব্রিড জাতের মধ্যে রয়েছে- লালতীরের টিয়া, ময়না, বলাকা, দোয়েল, গোল্ড রাইচারও গোল্ডেন ওয়ান। এসিআইয়ের ছক্কা, বিএডিসির এসএল-৮ এইচ( সুপার হাইব্রিড), বায়ারের ধানীগোল্প, ত্যাজগোল্ড, সুপ্রিম সীডের হীরা-২ ও হীরা-১৯ ও সিনজেন্টার ১২০৩ জাতগুলি চাষিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।হাইব্রিড জাতগুলোও ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল।চীন হাইব্রিড ধানের চাষ বৃদ্ধি করে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের কথা হলো বোরো ধানের ফলন বৃদ্ধি করে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ব্লাস্ট রোগ দমনের ব্যাপারে ধানচাষিদের আগাম সতর্ক করতে হবে। তাঁদেরকে ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ,অনকূল আবহাওয়া. দমন পদ্ধতি, ফলন বিপর্যয় এবং আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।এ জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে তার এলাকার সকল ধান চাষির সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, চাষি সভা ও উঠান বৈঠক করতে হবে।প্রত্যেক উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে চাষি প্রশিক্ষণ, লিফলেট, পোষ্টার ছাপানো ও বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। বিভিন্ন টেলিভিষন চ্যানেলে এব্যাপারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। তাহলে ব্লাস্ট রোগ দমনের ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি হবে , বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কৃষক লাভবান হবেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
…
লেখকঃ পরিচালক, কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ