কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
লিচু উৎপাদনে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি থাকলেও ধান-নদী-খালের জন্য বিখ্যাত পিরোজপুরে এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি বছর জেলার ৩৭ হেক্টর জমিতে ফলন হয়েছে ২০০ মেট্রিক টন চায়না থ্রী ও মোজাফফর পুরি জাতের লিচু। পাইকারি মূল্যে যার বর্তমান বাজার দর ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। লিচুর এ বাম্পার ফলনে আনন্দের জোয়ার বইছে কৃষকের ঘরে ঘরে। ফরমালিন মুক্ত ফল কিনে সস্তিতে আছেন এ অঞ্চলের ক্রেতারাও। এক ফসলি ধানের ক্ষেত সংস্কার করে ৫ একর জমিতে লিচুর আবাদ করেছেন নাজিরপুরের তারাবুনিয়া গ্রামের লিচু চাষি হংসপতি মিস্ত্রী। এলাকার সর্বত্র রয়েছে তার সুনাম। জানা গেছে, এই হংসপতি মিস্ত্রী ৯ বছর আগে প্রথম লিচুর আবাদ করেছিলেন। তার দেখাদেখি এলাকায় অনেকেই লিচু চাষ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন।
ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার তেমন কোন সুযোগ না পাওয়ায় বাবা প্রফুল্ল মিস্ত্রির সাথে জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল ফলাতেন পিরোজপুরের নাজিরপুরের শাঁখারিকাঠি ইউনিয়নের তারাবুনিয়া গ্রামের হংসপতি মিস্ত্রী। এভাবেই কেটে গেছে তার জীবনের ৪০টি বছর।
২০০৭ সালের কথা। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি প্রতিবেদন দেখার পর তার ফল চাষের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় । এই অঞ্চলে তিনিই প্রথম সফল লিচু চাষি। এর পর তার দেখা দেখি অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন লিচু চাষে।
ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা লোন নেন তিনি। আত্মীয়দের কাছ থেকেও আরও আড়াই লক্ষ টাকা ধার নিয়ে এক একর জমি তৈরী করেন ফল চাষের জন্য। এরপর ময়মনসিংহ ও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় ফলের বাগান ঘুরে সেখানকার চাষীদের কাছ থেকে ফল চাষের ওপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। প্রথমে কুল দিয়ে চাষ শুরু করেন। পরবর্তী বছর তিনি দিনাজপুর থেকে ১০০ লিচুর চারা সংগ্রহ করে ফলের বাগানে রোপন করেন। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাগানের কুল বিক্রি করে তিনি অনেক টাকা লাভ করেন। আস্তে আস্তে এক একরের ফলের বাগানকে তিন একরে রুপান্তরিত করেন। আর এই লাভের টাকা থেকেই তিনি আরও দুই একর জমি ক্রয় করে ফলের বাগান সম্প্রসারণ করেন। বর্তমানে হংসপতি পাঁচ একর জমিতে লিচু ও আমের বাগান তৈরী করেছেন। এসব বাগানে রয়েছে ৩৫০টি মুজাফফরপুরি ও চায়না-৪ জাতের লিচু এবং প্রায় ৮০০টি আ¤্রপালি ও মল্লিকা জাতের আম। এছাড়াও তার বাগানে রয়েছে কয়েক প্রজাতির লিচু, মালটা ও কমলা। বর্তমানে হংসপতির তার বাগানের লিচু বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তিনি জানান, সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত তিনি বাগানে লিচু বিক্রি করেন। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারী ক্রেতারা তার বাগানে আসেন লিচু ক্রয় করার জন্য। তিনি বাগান থেকে এক হাজার লিচু সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে বিক্রি করছেন। বর্তমানে লিচু ছাড়াও তার বাগানে আম গাছে ঝুলছে দৃষ্টি নন্দন আমের থোকা। আগামী এক মাসের মধ্যেই তিনি আম বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। গত বছর তিনি তার বাগান থেকে প্রায় ৪০০ মন আম বিক্রি করেছিলেন।
পাইকারি লিচু ক্রেতা স্বরূপকাঠির আব্দুল মালেক বলেন,ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা অনেক। দামের দিক তাকায় না। খুচরা বাজারে ১শ লিচু ৪শ থেকে ৪শ৫০ টাকায় অনায়াসে বিক্রি করা যাচ্ছে।
হংসপতির এত দূর আসার পিছনে তার স্ত্রী হেপি রাণী মিস্ত্রী সব সময় তার পাশে ছিলেন। তিনিই তার স্বামীর বাগান দেখাশোনার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করেন।
হেপি রাণী মিস্ত্রি জানান, বর্তমানে বাগান থেকে লিচু সংগ্রহের পর সেগুলো থোকা বাধার কাজে তিনি সহযোগিতা করেন। এছাড়াও বাগানের সব কাজেই তিনি তার স্বামীকে সহযোগিতা করছেন।
হংসপতি এখন তারাবুনিয়া গ্রাম তথা নাজিরপুর উপজেলার একজন আদর্শ ফল চাষী। তার দেখাদেখি ওই এলাকার দেড় শতাধিক কৃষক ফল চাষের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তারাবুনিয়া এলাকার প্রায় ৩০০ একর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফল চাষ হয়।
হংসপতি জানান, ৯ বছর আগে তিনি প্রথম যখন ফসলি জমি ধ্বংস করে ফল চাষ শুরু করেছিলেন, তখন সকলেই তাকে পাগল আখ্যায়িত করেছিল। আর বর্তমানে কৃষকরা তার কাছে আসেন ফল চাষের উপর পরামর্শ নিতে। তিনি আরও জানান, লিচু গাছে ফুল আসার পর তিনি কীটনাশক ব্যবহার করেন। এরপর আর কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন না। এই কারণেই তার বাগানের লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু এবং বাজারে তার ফলের রয়েছে আলাদা চাহিদা। তালতলা নদীর তীরে হংসপতির লিচু আর আমের বাগান যে কারও নজর কাড়ে। রাস্তা থেকে যাওয়ার সময় পথিকেরা ক্ষণিকের জন্য দাড়িয়ে যান হংসপতির নয়নাভিরাম ফলের বাগান দেখার জন্য। বর্তমানে হংসপতি তার উপার্জন থেকে নয় জন সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ করেন। এছাড়া তার ছেলে আকাশ মিস্ত্রি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং মেয়ে পূর্ণিমা মিস্ত্রি ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে।
হংসপতি জানান, বর্তমানে ফলের বাগানগুলোই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর বাগানের গাছগুলো তার সন্তানের মত।
হংসপতির সফলতার বিষয়ে ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পঙ্কজ কুমার বড়াল বলেন, হংসপতি একজন আদর্শ ফলচাষী। শুরু থেকেই আমরা তাকে কারিগরি সহয়তা দিয়ে আসছি। তিনি আরও জানান, হংসপতির দেখাদেখি ওই গ্রামে আরও প্রায় ২৫টি লিচু ও আমের বাগান গড়ে উঠেছে। বাগানগুলো আকারে ছোট হলেও, আস্তে আস্তে সেগুলোও বিস্তৃতি লাভ করবে বলে তিনি আশা করেন।
পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. আবুল হোসেন তালুকদার হংসপতির বাগান পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, এলাকায় এ বছর লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। স্থানীয় বাজার থেকে ফরমালিন মুক্ত এ রসালো ফল কিনে খুশী ক্রেতারাও। আশাকরা হচ্ছে জেলায় মোট ৩৭ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত লিচুর বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। চাষিদের মূখে দেখেছি আনন্দের হাসি।তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলের মাটি ফল চাষের জন্য উপযোগী। তাই এর বাম্পার ফলন হচ্ছে।