কৃষিবিদ মোঃ নুরুল হুদা আল মামুন*
****************************
শাক সবজি পুষ্টির অন্যতম আঁধার। অপুষ্টির প্রধান কারণ অপর্যাপ্ত সবজি গ্রহণ। পরিমিত পরিমাণ সবজি গ্রহণ না করলে শরীরে পুষ্টি উপাদান যেমন বিটা ক্যারোটিন গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। এফএও(FAO)এর তথ্য অনুসারে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২০০ গ্রাম সবজি প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার খাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে মাথাপিছু সবজি খাওয়ার হার মাত্র ৫৫ গ্রাম। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের শরীরে পরিমিত মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান যার মধ্যে ভিটামিন : ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে এবং খনিজ লবণ : ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ফসফরাস থাকা প্রয়োজন। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের সবজি গ্রহণের মাধ্যমে এর চাহিদা মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশে যত প্রকার সবজি জন্মে তার সিংহভাগ সবজি শীত কালে জন্মে।এবার জেনে নেওয়া যাক শীতকালীন সবজির গুনাগুন।
টমেটো
টমেটোর পুষ্টিগুনঃ
শীত কালে যে সব সবজি বেশি পাওয়া যায় তার মধ্যে টমেটো অন্যতম। টমেটো সবজি হিসাবে আমরা খাই ।কাঁচা টমেটো সালাদ আর রান্না করে তরকারি। প্রতি ১০০ গ্রাম টমেটোতে আছে: ভিটামিন এ ১০০০ আই ইউ,ভিটামিন- সি ২৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১ মিলিগ্রাম,লৌহ ০.৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৩৬০ মিলিগ্রাম, এবং প্রোটিন ১ গ্রাম। আছে নিকোটিনিক এসিড ও প্রচুর গ্লুটামিক এসিড (৮৬-১৪০ গ্রাম)। একশো গ্রাম টমেটো থেকে শক্তি পাওয়া যায় প্রায় ২০ ক্যালরি। টমেটোতে পানির পরিমাণ প্রায় ৯৪ শতাংশ।
উপকারিতাঃ
টমেটো শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এর ভিটামিন-এ ত্বককে সুন্দর রাখে।ভিটামিন সি স্কার্ভি প্রতিরোধ করে। ভিটামিন কে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। নিকোটিনিক এসিড রক্তের কোলেস্টেরল কমায়, তাই হৃদরোগ প্রতিরোধে টমেটো সহায়ক। গ্লুটামিক এসিড মস্তিস্ককে সুস্থ রাখে। টমেটোর পটাশিয়াম স্ট্রোক প্রতিরোধে কার্যকরী। ‘লাইকোপিন’ নামক এক ধরনের শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্টের উপস্থিতির কারণে টমেটোর রং লাল। টমেটোর ন্যায় এত অধিক লাইকোপিন আর কোন ফল বা সবজিতে নাই। লাইকোপিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। জরায়ুর মুখ, প্রষ্টেট, বৃহদন্ত্র, মলাশয়, পাকস্থলি, গ্রাসনালী, ইত্যাদি অংঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধে টমেটো সহায়ক বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ। লাইকোপিন শরীরে তৈরি হয়না, তাই বাইরে থেকে এর সরবরাহ প্রয়োজন। রান্নায় লাইকোপিন নষ্ট হয়না, বরং বাড়ে। তাই টমেটো তরকারীতে দিয়ে রান্না করে খাওয়ায়ও বাড়তি উপকার। দৈনিক তিন থেকে চারটি টমেটো খেলে এসব উপকার পাওয়া যাবে ।
লাউ
শীত কালে আমাদের দেশে লাউ বেশ পাওয়া যায়।ব্যাপক জনপ্রিয় ও সুস্বাদু সবজি লাউ। গ্রামে কিংবাশহরে সকল মানুষের কাছে পরিচিত এই সবজি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এ সবজি অত্যন্ত পুষ্টিকর। এসব কারণে লাউ আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। লাউ এর জন্ম ইতিহাস থেকে জানা যায়, এর আদি নিবাস আফ্রিকা। পরে তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেছড়িয়ে পড়ে। লাউ একটি লতানো জাতীয় উদ্ভিদ।
লাউয়ের পুষ্টিগুনঃ
লাউ এ ভিটামিন বি সি শর্করা ওখাদ্য শক্তি পাওয়া যায়। পাতায় এ সি ক্যালসিয়াম প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।বীজে থাকে ৪৫% ফ্যাট এসিড, প্রোটিন, অ্যামাইনোএসিড ইত্যাদি। বীজের তেলমাথাব্যথা দূর করে এবং লাউ রান্নায় সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পুষ্টিবিদদেরমতে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী লাউ গাছের পাতায় খাদ্য উপাদান হলো :প্রোটিন ২.৩ গ্রাম, শর্করা ৬.১ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম, ৮০গ্রাম, ক্যারোটিন ১৮৭ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন সি ৯০ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি৩৯ কিলোক্যালরি। ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী লাউ এ খাদ্য উপাদান হলো : জলীয় অংশ ৮৩.১ গ্রাম প্রোটিন ১.১ গ্রাম শর্করা ১৫.১ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৬ গ্রাম, লৌহ ০.৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি ৬৬ কিলোক্যালরি, খনিজ, পদার্থ ০.৫ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ২.৫গ্রাম, ফসফরাস ১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ১০.০৩ মিলিগ্রাম, বি ২.০১মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.০২ মিলিগ্রাম তাছাড়া ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ওমেগা ৬, ফ্যাটি এসিড আছে।
উপকারিতাঃ
লাউ এর নানা ওষুধি গুণাগুণও রয়েছে।যারা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভুগেন তারা নিয়মিত লাউ খেলে উপকার পাবেন। বিশেষ করে গর্ভবর্তী মহিলারা প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে আক্রান্ত হন। তারা লাউ খেয়ে উপকার পেতে পারেন। এক্ষেত্রে লাউ শাক খুবই উপকারী। যাদের খাবার কম হজম হয় বা অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে তাদের জন্য লাউ খুবই উপকারি সবজি।নিয়মিত খেলে কর্ম শক্তি বাড়ে। যাদের শরীর গরম, বা মাথা গরম থাকে তারা লাউখান উপকার পাবেন। যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তারা নিয়মিত লাউ খান উপকার পাবেন। লাউ খেলে শরীরের চামড়ার আর্দ্রতা বজায় থাকে। ফলে শীতকালে চামড়ার টান টান ভাব কমে যায়। যারা হাই-প্রেসারে ভুগেন তারা নিয়মিত লাউ খান উপকার পাবেন। কানের ব্যথা লাউ গাছের নরম ডগার রস দিলে উপকার পাওয়া যায়। লাউ গাছের পাতার রসের সাথে চিনি মিশিয়ে খেলে জন্ডিস রোগে উপকার হয়।রাতে যাদের ঘুম কম হয় তারা রাঁতের খাবারে লাউ রাখলে উপকার পেতে পারেন। যাদের সব সময় মাথা গরম থাকে তারা লাউ-এর বীজ বেটে মাথার তালুতে দিলে উপকার পাবেন। শরীরে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেড়ে গেল।বা জ্বর হলে লাউ এর শাস নরম করে কপালে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখলে খুবই উপকারপাওয়া যায়। তাপ শোষিত হয়ে যায়। খাওয়া অরুচি দেখা দিলে লাউ এর সবজি বা লাউ-এর বাকলের ভাজি খান সমস্যা কমে যাবে। এত উপকারী লাউ গাছ বাড়ির আশপাশে লাগান যত্ন নিন।পরিবারের তরকারি সমস্যা সমাধান হবে। সকলের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হবে।
বাধাকপি
বাধাকপি একটি সুস্বাদু শীতকালীন সবজি। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে একটি জনপ্রিয় খাবার এই বাধাকপি। এটি কাঁচা এবং রান্না দুইভাবেই খাওয়া যায়। স্বাদে ও গুণে অতুলনীয় এই সবজিটি বিশেষ পদ্ধতিতে চাষ করার কারণে মোটামুটি সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীত কালীন বাধাকপির স্বাদ তুলনামূলক ভাবে অন্য সময়ের চাইতে বেশি। শুধু স্বাদই নয় বাধাকপির রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ওজন কমানোর মত গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান।
বাধাকপির পুষ্টিগুনঃ
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম বাধাকপিতে রয়েছে ১.৩ গ্রাম প্রোটিন, ৪.৭ গ্রাম শর্করা, ০.০৬মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২ ও ৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। তাছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম বাধাকপিতে ৩১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮মিলিগ্রাম লৌহ, ৬০০ মাক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ২৬ কিলো ক্যালোরী খাদ্যশক্তি থাকে। আসুন জেনে নেয়া যাক কোন ৬টি কারণে বাঁধাকপি খাওয়া উচিত।
উপকারিতাঃ
নিয়মিত বাধাকপি খেলে আপনার আর মাল্টি ভিটামিন খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ বাধাকপিতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব ভিটামিনই আছে। বাধাকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও কে আছে। ভিটামিন সি হাড়ের বিভিন্নসমস্যা দূর করে। এছাড়াও বাধাকপিতে উপস্থিত ভিটামিন কে হারকে মজবুত রাখে।যারা নিয়মিত বাধাকপি খায় তারা বয়স জনিত হাড়ের সমস্যা থেকে রক্ষা পায়। বাধাকপিতে খুবই সামান্য কোলেস্টেরল ও সম্পৃক্ত চর্বি আছে। এছাড়াও বাধাকপিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আছে। ওজন কমাতে নিয়মিত সালাদে বাধাকপি খাওয়ার বিকল্প নেই। ওজন কমাতে চাইলে নিয়মিত খাবার তালিকায় প্রচুর পরিমাণে বাধাকপি রাখা ভাল।পাকস্থলির আলসারও পেপটিক আলসার প্রতিরোধে বাধাকপির জুড়ি নেই। বাধাকপি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ত্বক ভালো রাখতে বাধাকপি ভাল কাজ করে। এর কাঁচাপাতা যদি রোজ ৫০ গ্রাম করে খেলে পায়রিয়া এবং দাঁতের অন্য কোন সমস্যা থাকবে না৷ প্রতিদিন বাঁধাকপির পাতা ৫০ গ্রাম খেলে আপনার মাথায় চুল গজাবে৷ বাধাকপির রস খেলে ঘা সেরে যায়।
——————–
লেখকঃ পি এইচ ডি গবেষক, লেখক ও কবি।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম